৮০ শতাংশ পলিসিই পূর্ণতা পায় না

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৬ পিএম, ০৪ অক্টোবর ২০১৮

>> বছর ব্যবধানে নতুন পলিসি বিক্রির প্রিমিয়াম আয় কমছে
>> কোম্পানিটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ও কমেছে
>> পলিসি তামাদির হার ‘সন্দেহজনক’- বলছেন সংশ্লিষ্টরা
>> ‘অসৎ কর্মকর্তাদের’ ভুয়া পলিসি দেখানোও অন্যতম কারণ

বছরের পর বছর ধরে আইন লঙ্ঘন করে বীমাগ্রাহক (পলিসিহোল্ডার) ও শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ খরচ এবং সম্পদ ও বিনিয়োগ ভেঙে খাওয়া পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিক্রি করা ৮০ শতাংশ পলিসি পূর্ণতা পাচ্ছে না। প্রতি বছর কোম্পানিটি থেকে গ্রাহকরা যে বীমা পলিসি ক্রয় করছেন বছর না ঘুরতেই তার সিংহভাগ তামাদি (বন্ধ) হয়ে যাচ্ছে। 

গ্রাহককে ফাঁকি দেয়া অথবা ভুয়া পলিসি খুলে কোম্পানি থেকে অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কারণে এভাবে পলিসি তামাদি হয়ে যাচ্ছে বলে সন্দেহ করছেন বীমা সংশ্লিষ্টরা।

তারা জানান, জীবন বীমার একটি পলিসি কেনার পর দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তা তামাদি হয়ে গেলে কোম্পানি লাভবান হয়। কারণ এ ক্ষেত্রে আইন অনুসারে গ্রাহক কোনো টাকা দাবি করতে পারেন না। দুই বছরের বেশি কিন্তু ছয় বছরের কম সময়ের মধ্যে পলিসি তামাদি হলে গ্রাহক কিছু টাকা ফেরত পান। তবে তা গ্রাহকের জমা করা অর্থের থেকে কম। গ্রাহককে জমা করা অর্থের সম্পূর্ণ অংশ ফেরত পেতে হলে অবশ্যই ছয় বছর পর্যন্ত নিয়মিত বীমা পলিসির প্রিমিয়ামের টাকা জমা দিতে হয়।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পদ্মা ইসলামী লাইফে প্রতি বছরই দ্বিতীয় বর্ষে (পলিসির মেয়াদ দুই বছর) এসে ৫০ শতাংশের ওপরে পলিসি তামাদি হয়ে যায়। তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ বছর পর্যন্ত পলিসি তামাদি হওয়ার হার ৬০ শতাংশের ওপরে। এভাবে প্রতি বছর পলিসি তামাদি হওয়ার কারণে কোম্পানিটি গ্রাহকের আস্থা হারাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে বীমা পলিসি বিক্রির পরিমাণ। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রথম বর্ষ ও নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ে। 

জাগো নিউজের কাছে জীবন বীমা কোম্পানিটির ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের তামাদি পলিসি এবং প্রিমিয়াম আয় সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০১৭ সালে দুই বছর হয়েছে এমন পলিসি তামাদির হার ৫০ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা আগের বছর ২০১৬ সালে ছিল ৪৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এছাড়া ২০১৫ সালে ৬৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ২০১৪ ও ২০১৩ সালে ৫৬ দশমিক ৯০ শতাংশ করে পলিসি দ্বিতীয় বছরে এসে তামাদি হয়েছে।

পদ্মা ইসলামী লাইফে বীমা পলিসি তামাদি হওয়ার চিত্র- 

পলিসির মেয়াদ

তামাদির হার (শতাংশ)

২০১৭

২০১৬ 

২০১৫

২০১৪

২০১৩

তৃতীয় বছর

৬৫.০১

৭১.৭৯

৭১.৪৬ 

৬৯.১৪

৬৪.৭৯ 

চতুর্থ বছর

৬৫.২১ 

৬৭.১১ 

৭৭.৫২

৭২.০৬

৬৭.৭৪

পঞ্চম বছর

৫৭.৪৪

৫৩.৩৮

৮০.১৯

৭৬.৩৪ 

৭৪.৬৯ 

ষষ্ঠ বছর

৭৮.৬৮ 

৭৯.৮০ 

৮৩.৬১ 

৮০.৮৫ 

৮৩.০৭ 

এদিকে ২০১৭ সালে পদ্মা ইসলামী লাইফ নতুন পলিসি বিক্রি করে প্রিমিয়াম আয় করেছে ৪২ কোটি ১৩ লাখ টাকা, যা আগের বছর ২০১৬ সালে ছিল ৫৩ কোটি দুই লাখ টাকা। এ হিসাবে বছর ব্যবধানে কোম্পানিটির নতুন পলিসি বিক্রি বাবদ প্রিমিয়াম আয় কমেছে ১০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। প্রিমিয়াম কমার এ হার ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

নতুন পলিসির প্রিমিয়াম আয়ের পাশাপাশি কোম্পানিটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ও কমেছে। ফলে মোট প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণও কমেছে। ২০১৭ সালে জীবন বীমা কোম্পানিটি নবায়ন প্রিমিয়াম বাবদ আদায় করেছে ৬৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ৭৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে নবায়ন প্রিমিয়াম কমেছে ১৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। নবায়ন প্রিমিয়াম কমার হার ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ।

একটি জীবন বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, মোটা অঙ্কের বীমা পলিসি তামাদি হয়ে গেলে প্রিমিয়াম আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে- এটাই স্বাভাবিক। মোটা অঙ্কের পলিসি তামাদি হয়ে যাওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো- ভুয়া পলিসি। কিছু বীমা কর্মকর্তা আছেন ভুয়া পলিসি দেখিয়ে কোম্পানি থেকে অবৈধভাবে টাকা তুলে নেন। কারণ নতুন প্রতিটি পলিসির ৯০ শতাংশ অর্থ কোম্পানি কমিশনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় করতে পারে। এতে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এক শ্রেণির কর্মকর্তা লাভবান হন। পদ্মা ইসলামী লাইফে যে হারে পলিসি তামাদি হচ্ছে তা সন্দেহজনক। কোম্পানিটি ভুয়া পলিসি দেখাচ্ছে কিনা- তা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা উচিত।

যোগাযোগ করা হলে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সদস্য গোকুল চাঁদ দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘পদ্মা ইসলামী লাইফের আর্থিক অবস্থার চিত্র এখন আমার কাছে নেই। তাৎক্ষণিক একটি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা দেখাও সম্ভব নয়। তবে পদ্মা ইসলামী লাইফ কোনো অনিয়ম করলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।’

মাত্রাতিরিক্ত পলিসি তামাদি হওয়ার বিষয়ে পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান এফ এম ওবায়দুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেক গ্রাহক পলিসির প্রিমিয়ামের টাকা ঠিকমতো জমা দেন না। পলিসি তামাদি হয়ে যাওয়ার পেছনে এটি একটি কারণ। এছাড়া ভুয়া পলিসির কারণেও কিছু পলিসি তামাদি হয়।’

তিনি বলেন, ‘এ কথা আমি অস্বীকার করবো না যে, প্রত্যেক জেলায় আমাদের কিছু অসৎ কর্মকর্তা আছেন, যারা কিছু ভুয়া পলিসি দেখান। তারা কোম্পানির টাকা জমা দেয়ার রশিদ নকল করে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেন। এসব টাকা কোম্পানিতে জমা হয় না। এ কারণে বীমা পলিসি তামাদি হয়ে যাওয়ার হার একটু বেশি। বিশেষ করে যেসব পলিসির মেয়াদ পাঁচ-ছয় বছর হয়েছে, সেসব পলিসি বেশি তামাদি হয়ে যাচ্ছে।’

এমএএস/এমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।