খেলাপি ঋণে ডুবছে ব্যাংক খাত

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:২২ পিএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

>> এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা
>> অবলোপনসহ মোট খেলাপি ঋণ এক লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা
>> ২০১৮ জুন শেষে খেলাপি ঋণ ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা
>> ২০১৭ ডিসেম্বর শেষে ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা
>> বেসরকারি ব্যাংকে বেড়েছে খেলাপি ঋণ, কমেছে সরকারি ব্যাংকে

অনিয়ম, দুর্নীতি করে দেয়া হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ। কিন্তু আদায় হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ডুবতে বসেছে ব্যাংক খাত। চলতি বছরের জুন শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি জুন-১৮ প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জুনশেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৫৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। রাইট অফ বা অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ যোগ হলে খেলাপি ঋণ দাঁড়াবে এক লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দিচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করছেন। এছাড়া ঋণ বিতরণে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে। যাচাই-বাছাই না করেই দেয়া হচ্ছে ঋণ। বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠন করা ঋণ আবার খেলাপি হচ্ছে। ফলে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ।

খেলাপি ঋণের বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন না হলে আগামীতে ভয়াবহ রূপ নেবে দেশের ব্যাংক খাত- এমন মন্তব্য তাদের।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডা. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। এ খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব। এ কারণে এ খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা জেঁকে বসেছে।

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো যাচাই-বাছাই না করেই নামে-বেনামে ঋণ দিচ্ছে। ঋণের অর্থ নিয়মিত আদায় হচ্ছে না। আবার বিশেষ সুবিধায় এসব ঋণ পুনর্গঠনও হচ্ছে। ঋণের অর্থ পরিশোধ করছে না ঋণগ্রহীতারা। ফলে বেড়েই চলছে খেলাপি ঋণ।

‘এ খেলাপি ঋণ এখন ব্যাংকের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ খেলাপির বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয়। এটি রাখতে গিয়ে অনেক ব্যাংক মূলধনও খেয়ে ফেলছে। তাই খেলাপি ঋণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর হতে হবে।’

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের জুনশেষে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। ওই সময় বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল সাত লাখ ৩১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনশেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল) ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে। এই সময়ে এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। এই সময় ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল এক লাখ ৫১ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। মার্চশেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৪৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৮৩৩ কোটি টাকা কমেছে।

বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণও কমেছে। জুনশেষে বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ২৪১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। মার্চশেষে বিশেষায়িত এই দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল পাঁচ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে ওই দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ১৮৫ কোটি টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমলেও বেড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। জুনশেষে ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকের বিতরণ করা ছয় লাখ ৪৮ হাজার ৫০১ কোটি টাকার মধ্যে ৩৮ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকাই খেলাপিতে পরিণত হয়, যা মোট ঋণের ছয় দশমিক শূন্য এক শতাংশ। গত মার্চ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৩৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা।

বিদেশি ৯ ব্যাংকেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ

চলতি বছরের জুনশেষে বিদেশি নয় ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৩৪ হাজার ৮৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২৭১ কোটি টাকা। মার্চশেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে বিদেশি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮৩ কোটি টাকা।

তিন শ্রেণির খেলাপি ঋণ

খেলাপি ঋণ তিনটি শ্রেণিতে বিভাজন করা হয়। একটি নিম্নমান, সন্দেজনক এবং মন্দ বা ক্ষতিজনক মান। মন্দ বা ক্ষতিজনক মানের ঋণ আদায় হবে না বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, মোট খেলাপি ঋণের ৭৩ হাজার কোটি টাকাই মন্দ ঋণ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশির ভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ আছে। এর একটি হলো- প্রভিশন সংরক্ষণ। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়।

এছাড়া নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়।

এসআই/জেডএ/এমএআর/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।