দেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারে পিপিপি

মেসবাহুল হক
মেসবাহুল হক মেসবাহুল হক , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:১০ পিএম, ১৭ আগস্ট ২০১৮

নয় বছরে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের হার মোটেও সন্তোষজনক নয়। যদিও এ উদ্যোগে অনেক দেশেই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়েছে। যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ভিয়েতনামের মতো যদি পিপিপিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে দেশের চেহারাই পাল্টে যাবে- এমন পর্যবেক্ষণ অর্থ মন্ত্রণালয়ের।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নয় বছর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পিপিপির ভিত্তিতে অবকাঠামো খাতের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখান। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে তা বাস্তবায়ন হয়নি।

মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়, একনেকে পাস হওয়ার পর অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন থেকে প্রকল্প পরিচালকসহ (পিডি) বেশকিছু জনবল নিয়োগ দেয়া হয়। তারপর পিডি তার কর্মকর্তাদের নিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডিসহ আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করে প্রকল্পটি ফাইনাল করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নে ফিজিবিলিটি স্টাডিসহ অন্যান্য কাজের জন্য কোনো পিডি বা জনবল নিয়োগ দেয়া হয় না। যে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রকল্প সে সংস্থার এক কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত কাজ হিসেবে প্রকল্পটি প্রস্তুত করতে বলা হয়। এ কারণে পিপিপি প্রকল্পে গতি আসে না।

এ ধরনের প্রকল্পে গতি আনতে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে একটি করে পিপিপি সেল খুলতে হবে। এখনকার কর্মকর্তারা নিজেরাই সমীক্ষা করে দেখবেন প্রকল্পটি পিপিপিতে অর্থবহ কিনা? সমীক্ষার পর যদি দেখা যায় অর্থবহ হবে, তাহলে পরের ধাপে যাওয়া উচিত।

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, দেশের ব্যবসায়ীদের পিপিপির বিষয়টি যুক্তি দিয়ে ভালোভাবে বুঝিয়ে সন্তুষ্ট করতে হবে। তাদের বলতে হবে, ঢাকার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন বড় শহরগুলোকে দ্রুত সংযোগ স্থাপনে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-পায়রা বন্দর পর্যন্ত বুলেট ট্রেন নির্মাণ করে দিতে হবে। এর জন্য জমি দেবে সরকার। আর প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বাস্তবায়নকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করে লাভ করবে। শুধু ভাড়া কতো- সেটা সরকার নির্ধারণ করবে। ইস্তাম্বুলের মতো শহরেও দ্বিতল বুলেট রেল লাইন রয়েছে। একটা দিয়ে যায়, অন্যটা দিয়ে আসে। সে (তুরস্ক) দেশে এসব অবকাঠামো পিপিপির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও এভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব।

অর্থ বিভাগ বলছে, পিপিপি পদ্ধতিতে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে ঢাকার ওপর চাপও কমবে। আশপাশের জেলার লোকজন বাসা থেকেই ঢাকায় অফিস করতে পারবেন। পিপিপিকে আকৃষ্ট করতে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বেশি বেশি আলোচনা করতে হবে। ইতোমধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আকৃষ্ট করতে পিপিপি প্রকল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কছাড় দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আরও কিছু প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে।

‘ব্যবসায়ীদের তাদের ল্যাঙ্গুয়েজে পিপিপির বিষয়ে বুঝাতে হবে। তাদের ডেকে বলতে হবে, চারটা রাস্তা বানিয়ে দাও। ৩০ বছর টোল আদায় করে লাভ করো। এতে তোমাদের কী কী সমস্যা আছে, বলো। এভাবে ব্যবসা কি লাভজনক নয়? তাহলে ব্যবসায়ীরা অবশ্যই তাদের সমস্যার কথা বলবে। এসব সমস্যা উভয় পক্ষ মিলে সমাধান করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে- যোগ করেন অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

তিনি জানান, যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলে প্রতিটি জেলা শহরে একটি করে পিপিপির ভিত্তিতে হাসপাতাল নির্মাণ হবে। সরকার জায়গা দেবে, ব্যবসায়ীরা অবকাঠামো নির্মাণ করবে। তারপর ডাক্তার ফি ও টেস্ট ফি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার নির্ধারণ করে দেবে। এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে তুলানামূলক অনেক কম খরচে জনগণকে ভালোমানের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সম্ভব। আবার যেহেতু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানকে চড়া দামে জমি কিনতে হয়নি তাই অল্প ফি নিয়েই সে লাভ করতে পারবে। এতে জনগণও ভালো চিকিৎসাসেবা পাবে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে দেশের চেহারাই পাল্টে দেয়া সম্ভব।

পিপিপির প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন দফতরে সেবা নিতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের অনেক সময় অপচয় হয়। বিনিয়োগ করতে এসে সময় বেশি লেগে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিরক্ত হন। পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে একজন ব্যবসায়ীকে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা অনেক লম্বা। সরকারের এক সংস্থার সঙ্গে আরেক সংস্থার সমন্বয়হীনতা বেশ লক্ষণীয়। তাই এক্ষেত্রে টেন্ডার বাদ দিয়ে জাতীয় অগ্রাধিকার প্রকল্প অর্থাৎ ন্যাশনাল প্রায়োরিটি প্রজেক্ট (এনপিপি) হিসেবে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ আফসার এইচ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অর্থাৎ পিপিপির মাধ্যমে দেশে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

তিনি আরও বরেন, এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। নিশ্চিত করতে হবে নীতির ধারাবাহিকতা। একই সঙ্গে প্রচারণা বাড়ানো দরকার। কারণ বাংলাদেশে পিপিপি নামে একটি নতুন ধারণা তৈরি হয়েছে, সেটি এখনও অনেকে জানেন না। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষকে বিষয়টি জানাতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘পিপিপির ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তাই এক্ষেত্রে শুধু সরকার এগিয়ে আসলে হবে না, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে না আসলে পিপিপি পদ্ধতি কার্যকর হবে না। এ জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পিপিপিতে আগ্রহী করতে সরকারকেও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

এমইউএইচ/এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।