নয় বছরে বাস্তবায়ন মাত্র তিন প্রকল্প
>> পার্টনার হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পাওয়া যায় না
>> নানা জটিলতায় এগিয়ে আসছে না বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
>> প্রতি বছর বাজেটে অর্থ বরাদ্দ থাকলেও ব্যবহৃত হচ্ছে না
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে গঠন করা হয় পিপিপি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গত নয় বছরে পিপিপির ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের হার মোটেও সন্তোষজনক নয়।
এ সময়ের মধ্যে মাত্র তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রতি বছর বাজেটে এ খাতে অর্থ বরাদ্দ থাকলেও তা অব্যবহৃত থাকছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
মন্ত্রণালয় জানায়, এখন পর্যন্ত পিপিপি ভিত্তিতে মোট তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- হেমোডায়ালাইসিসি সেন্টার অ্যাট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, হেমোডায়ালাইসিসি সেন্টার অ্যাট ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড উইরোলজি (এনআইকেডিইউ) এবং মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার। কিন্তু হানিফ ফ্লাইওভার পিপিপির ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হলেও তা পিপিপি আইন মেনে হয়নি। এ কারণে সরকারিভাবে এটি পিপিপিতে বাস্তবায়িত প্রকল্প হিসেবে গণ্য হয় না।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ পদ্ধতি যখন বেশ জনপ্রিয় তখন বাংলাদেশে এর দৈন্যদশা কেন- এ বিষয়ে খোদ অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করে, পিপিপির বিষয়ে মানুষের ধারণা এখনও স্পষ্ট নয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের যেসব কর্মকর্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন এ বিষয়ে তাদের ধারণাও স্পষ্ট নয়। তাই পিপিপির ভিত্তিতে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয় সেসব প্রকল্পে পার্টনার হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, পিপিপির ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য এমন প্রকল্প হাতে নেয়া উচিত যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে লাভজনক হবে। অর্থাৎ পিপিপি প্রকল্পগুলো এমন হতে হবে যাতে প্রকল্পগুলো নিজেদের অর্থে বাস্তবায়ন হবে এবং এর পার্টনার অর্থাৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লাভবান হবে।
এক্ষেত্রে টেন্ডার কার্যক্রমে কোনোরূপ বাড়তি সুবিধা না পাওয়াকে ‘সমস্যা’ হিসেবে দেখছেন ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘সাধারণ ক্ষেত্রে একটা টেন্ডার করলেই এর সঙ্গে জড়িতরা নানা ধরনের সুবিধা পান। কিন্তু পিপিপি প্রজেক্ট যখন নেয়া হয় তখন তাতে কোনো টাকা-পয়সা থাকে না। বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত কোনো সুবিধা নেই। পিপিপি প্রজেক্টে প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) কোনো সুবিধা থাকে না। কারণ এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান।’
এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার উপয় কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের পিডি সিলেকশনের সময় যাদের একটু পয়সাপাতির দিকে নজর কম অর্থাৎ ভালো অফিসারদের নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া পিডিদের বিদেশে ট্রেনিংয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে এ ক্ষেত্রকে আরও লুকরেটিভ (লোভনীয়) করতে হবে। প্রমোশনও (পদোন্নতি) একটু তাড়াতাড়ি দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ মানুষের ধারণা যে, পিপিপি মানে প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার সরাসরি অর্থ দেয়। কিন্তু আসলে সরকার এক্ষেত্রে কোনো অর্থ দেয় না। সরকার শুধু জায়গা দেয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে যত অর্থ খরচ হয় তা ব্যয় করতে হয় পার্টনার অর্থাৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে। এক্ষেত্রে এডিবি যে ঋণ দেয় সেটাও বাস্তবায়নকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়।
তাহলে পিপিপির জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয় কেন- এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাজেটের বরাদ্দ অর্থ থেকে টেকনিক্যাল স্টাডিজের জন্য প্রতি বছর ১০০ কোটি টাকা করে পিপিপি কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়। বাকি অর্থ রাখা হয় ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিং (ভিজিএফ)-এর জন্য। চলতি অর্থবছরেও পিপিপি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা।’
ভিজিএফ-এর ব্যাখায় তিনি বলেন, ‘যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে তার খরচ হলো ১০০ কোটি টাকা। ধরেন হানিফ ফ্লাইওভারে ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ প্রকল্পের বেসরকারি পার্টনার ওরিয়ন গ্রুপ ২০ বছর টোল আদায় করবে। ২০ বছর পর ১০০ কোটি টাকা সুদসহ প্রায় দাঁড়াবে ১২০ কোটি টাকা। কিন্তু ওরিয়ন গ্রুপ ২০ বছরে টোল আদায় করবে ৮০ কোটি টাকা। বাকি ৪০ কোটি টাকার গ্যাপটা সরকার ভর্তুকি দিয়ে ফিলাপ করবে। এটাই ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিং।’
ভিজিএফ না দিয়ে মেয়াদ ২০ বছরের চেয়ে বেশি দেয়া যায় কি না- জানাতে চইলে তিনি বলেন, ‘দেয়া যায় তবে ফাইন্যাসিং হিসাবে গিয়ে সেটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান করতে রাজিহয় না। কারণ সুদের হার হিসাব করে সেটা আর কাভার করে না। কারণ পাঁচ বছর পর যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ১০০ টাকা পায় আজ তার মূল্য ৮০ টাকারও কম।’
তিনি বলেন, ‘প্রজেক্ট টেন্ডার করার আগে ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিং বিষয়ে ফাইন্যান্স ডিভিশনে একটা আবেদন আসে। তবে এ গ্যাপ মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৩০ শতাংশের মধ্যে হতে হয়। তারপর যদি অর্থ বিভাগ সম্মতি দেয় তবে প্রকল্পের টেন্ডার হয়। যে প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে কম ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিং অফার করে সে প্রতিষ্ঠান কাজটি পায়।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘প্রকল্প যদি সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয় তাহলে ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিংয়েরও দরকার হয় না। যেমন- হেমোডায়ালাইসিসি সেন্টার অ্যাট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হসপিটাল ও হেমোডায়ালাইসিসি সেন্টার অ্যাট ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড উইরোলজি (এনআইকেডিইউ) প্রকল্প দুটি লাভজনক। তাই এসব প্রকল্পে ভিজিএফের প্রয়োজন হয়নি।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘পিপিপি হচ্ছে সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কিছু করা। তাই এক্ষেত্রে শুধু সরকার এগিয়ে আসলে হবে না, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে না আসার কারণ হচ্ছে, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগকে তারা লাভজনক মনে করছে না। হয়তো এক্ষেত্রে কিছু প্রফিট আসবে তবে দীর্ঘমেয়াদের। তাই এ খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি বিনিয়োগ করতে চায় না। এছাড়া পিপিপির ক্ষেত্রে প্রকল্প নির্বাচন এবং বাস্তবায়নের পর কালেকশন- এসব বিষয়ে জটিলতা রয়েছে।’
এছাড়া পিপিপি এক্সপার্টিজ সমস্যাও রয়েছে। তাই পিপিপিতে প্রাইভেট সেক্টরের অনীহা এখনও রয়ে গেছে। এসব কারণে পিপিপি ভালো করতে পারছে না- যোগ করেন তিনি।
এমইউএইচ/এমএআর/আরআইপি