আগ্রাসী ঋণে লাগাম টানা জরুরি

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৫৩ পিএম, ২৫ জুলাই ২০১৮

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিয়ে মুদ্রা ও ঋণ সরবরাহে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহ, ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতি ও সহায়ক মুদ্রানীতি আসতে হবে।

এক্ষেত্রে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গতানুগতিক নিয়মে না গিয়ে গুণগত দিকে বেশি নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচনী বছরে অর্থপাচার ও অবৈধ লেনদেন ঠেকাতে আগ্রাসী বিনিয়োগ বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন সাবেক গভর্নর ও বিশেষজ্ঞরা।

চলতি মাসের শেষদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের (জুলাই-জানুয়ারি) মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।

বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ মুদ্রানীতি কেমন হওয়া উচিত- এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুদ্রানীতিতে সাধারণত বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ও সুদহারের বিষয়ে নির্দেশনা থাকে। তবে আমাদের ব্যাংক ও বাজারের যে ধরন; তাতে বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ হয় না। ব্যাংকের ঋণের সঙ্গে সুদহারের সম্পর্ক কম। তাই বাজারে ঋণপ্রবাহ ও সুদহারের ওপর মুদ্রানীতির প্রভাব তেমন পড়ে না।’

আসন্ন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘নির্বাচনী বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে গত কয়েক মাস ধরে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে। গত মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তার চেয়ে বেশি বিতরণ হয়েছে। এটা মূলত নির্বাচন কেন্দ্রীক। নির্বাচনে খরচের জন্য আগে থেকেই ঋণ করা হচ্ছে। কিছু অর্থ পাচার হচ্ছে। ঋণের এ প্রবাহ নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।’

‘এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানতের অনুপাত (এডি রেশিও) কমাতে পরে। কিন্তু তারা উল্টো পথে হাঁটছে। তারা এটি কমিয়ে বাস্তবায়ন না করে তা শিথিল করেছে। যেখানে ঋণের সরবরাহ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেড়েছে। কিন্তু বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না, কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। তাহলে এ ঋণ কোথায় যাচ্ছে? এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তদারকি বাড়াতে হবে এবং মুদ্রানীতিতে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে।’

এর আগে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। যা প্রথমার্ধে ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়া মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৬ শতাংশ। আগে ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রায় রাখা হয়। যার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, চলতি বছরে জাতীয় নির্বাচনের কারণে কালো টাকার প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বাজারে নগদ অর্থের প্রবাহে লাগাম টানার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল গেল অর্থবছরের (জানুয়ারি-জুন) দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে। এছাড়া ঋণের প্রবৃদ্ধি মাত্রারিক্ত বাড়ার কারণে ঋণের লাগাম টেনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ আমানতের অনুপাত হার কমিয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে ব্যাংকগুলোর জোরাজুরিতে নতুন এ হার কার্যকরের সময়সীমা বাড়ানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুদ্রানীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নির্ধারণ করা। কারণ এখন তারল্য সংকট রয়েছে। আবার ব্যাংকগুলো সুদহার কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে বিশেষ করে খাদ্রপণ্যের মূল্যস্ফীতি। আমদানি বেড়েছে, সেই হারে বাড়েনি রফতানি। রেমিট্যান্সের ওপর চাপ বেড়েই চলেছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার অস্থির। এছাড়া আগামীতে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণও নেবে। সব মিলিয়ে সামনে যে মুদ্রানীতি আসবে তা বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জই হবে।’

এ পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতি কেমন হওয়া উচিত- জানতে চাইলে সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহ, ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতি ও সহায়ক মুদ্রানীতি ঘোষণা দিতে হবে। এক্ষেত্রে গুণগত দিকে বেশি নজর দিতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী শুধু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ না করে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গেল মুদ্রানীতিতে বেশিরভাগ লক্ষ্যমাত্রই অর্জিত হয়নি। এ বিষয়ে নজর দিতে হবে। গতবার ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ কিন্তু সেটি ১৮ শতাংশ অর্থাৎ আগ্রাসী ঋণ বিতরণ করে ব্যাংকগুলো।’

তিনি বলেন, ‘বেসরকারি ঋণ কোন কোন খাতে যাচ্ছে এটি নিশ্চিত করতে হবে। এটা শুধু আমদানি আর সেবা খাতে চলে যাচ্ছে কি না- তা দেখতে হবে।‘ একই সঙ্গে বেসরকারি ঋণ উৎপাদনশীল ও এসএমই খাতে যেন যায় তা নিশ্চিতের তাগিদ দেন তিনি।

‘ব্যাংকগুলো সুদহার কমানোর যে ঘোষণা দিয়েছে তা কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, এটি করলে কোনো প্রভাব পড়বে কি না- তার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা ও বিভিন্ন কৌশল মুদ্রানীতিতের থাকা উচিত’ বলেও জানান তিনি।

‘বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কিছুটা অস্থির’ উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমদানি চাপ বেড়ে যাচ্ছে। এটি নিয়ন্ত্রণে কী করা যায় তার নির্দেশনা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু ডলার বিক্রি করে চাপ কমাবে- এটাও প্রকৃত সমাধান নয়। এক্ষেত্রে কীভাবে রেমিট্যান্স, এক্সপোর্ট বাড়ানো যায়, ইমপোর্ট কামনো যায়- এসব বিষয়ে সঠিক কৌশল থাকতে হবে।’

সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘এটা নির্বাচনী বছর। এ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি ঋণের ক্ষেত্রে লাগাম না টেনে যদি ছেড়ে দেয়; তাহলে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে আগ্রাসী ঋণ বিতরণ করবে। নির্বাচনের জন্য অনেকে ঋণ চাইবে। তাই অহেতুক যেন ঋণ চলে না যায় সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

‘এছাড়া ৯ শতাংশে ঋণ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। এখন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনের ঋণ নেয়ার চেষ্টা থাকবে। এটিও যথাযথভাবে মনিটরিং করতে হবে।’ ব্যাংকিং খাতে এখন তারল্য সংকট চলছে। এ সময়ে সরকার যেন এ খাত থেকে ঋণ নিয়ে বাড়তি চাপ না দেয় সে বিষয়েও নজর রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

প্রসঙ্গত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি বছর দুবার মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে। ছয় মাস অন্তর এ মুদ্রানীতি একটি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাইয়ে এবং অন্যটি জানুয়ারিতে প্রণয়ন ও প্রকাশিত হয়।

দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পরবর্তী ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়।

এসআই/এমএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।