অর্থ উদ্ধার মামলার খরচেই উদ্বিগ্ন মন্ত্রণালয়

মেসবাহুল হক
মেসবাহুল হক মেসবাহুল হক , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:০৫ এএম, ০৮ জুলাই ২০১৮

রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের (আরসিবিসি) বিরুদ্ধে মামলা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ফৌজদারি এ মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত এপ্রিলেই এ মামলা দায়ের হবে বলেও জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের মামলা পরিচালনায় ব্যয় অনেক। তাই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন অর্থ মন্ত্রণালয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

গত ৪ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধার সংক্রান্ত্র আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘চুরি যাওয়া রিজার্ভের বাকি অর্থ ফেরত আনতে মামলার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা আগামী এপ্রিলেই (গত হয়ে যাওয়া এপ্রিল মাস) অর্থ উদ্ধারে মামলা করতে চাই। নিউইয়র্কের আদালতে এ মামলা করা হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় রিপোর্ট সিআইডিকে তাড়াতাড়ি দিতে বলা হয়েছে।’

মামলার জন্য কোনো ল ফার্ম নিয়োগ দেয় হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে মুহিত বলেন, ‘নিয়োগ দেয়া হয়নি। তবে আমেরিকার একটি ফার্মকে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’

তিনি বলেন, ‘এ মামলায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংককে আমরা পার্টি করতে চাই।’ ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক কি পার্টি হতে রাজি হয়েছে- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘রাজি হয়নি। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যোগাযোগ করছেন।’

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (ফেড) রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। পাঁচটি সুইফট বার্তার মাধ্যমে চুরি হওয়া এ অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় যাওয়া দুই কোটি ডলার ফেরত আসে। তবে ফিলিপাইনে যাওয়া আট কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে এখনও ফেরত আসেনি ছয় কোটি ৬৪ লাখ ডলার।

তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিল পার হয়ে আরও তিন মাস অতিবাহিত হলেও মামলা করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ খোঁজ নিয়ে দেখেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের মামলা পরিচালনার ব্যয় অনেক বেশি। তাই অর্থ ফেরাতে সরকারের সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও শিগগিরই মামলা হচ্ছে না। কারণ মামলার ব্যয় পরিচালনার বিষয়টি অর্থ বিভাগকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান বলেন, ‘রিজার্ভ চুরির বাকি অর্থ ফেরাতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। মামলা করার বিষয়টিও আমাদের মাথায় রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের মামলা পরিচালনার ব্যয় অনেক। তাই হুট করেই মামলা করে দিলে তো হবে না। মামলা করার বিষয়ে আমরা আরও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেব।’

এদিকে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়ী প্রতিষ্ঠান রিজাল কমার্সিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার বিকল্প পথ খোলা রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৩-৬ মে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৫১তম বার্ষিক সভায় যোগ দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ব্যাংকো সেন্ট্রাল এনজি ফিলিপিন্স’ (বিএসপি) এর গভর্নর নেস্টর ইস্পিনিলারের সঙ্গে বৈঠক করে মামলার বাইরে বিষয়টি সমাধানের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাবেরও কোনো ফলাফল এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

এছাড়া ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে আইনি পথে আত্মসাৎ হওয়া অর্থ উদ্ধারে সফলতা পাওয়ার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। আইন ও ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, মামলা করে টাকা ফিরে পাওয়া কঠিন। রয়টার্সের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আত্মসাৎ হওয়া অর্থ উদ্ধারে সমঝোতামূলক বিকল্প পথ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।

নিজস্ব অনুসন্ধান সূত্রে তাদের দাবি, মামলা নিষ্পত্তির এক মাস আগে ইকুয়েডরের একটি ব্যাংক ও মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওয়েলস ফার্গোর মধ্যে সমঝোতা হওয়ার একটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক উপ-পরিচালক সরাসরি এ কথা স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানালেও নিশ্চিত করেছেন যে, সম্ভাব্য বিভিন্ন বিকল্প পথের মধ্যে ইকুয়েডরের ঘটনাটিও তাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। আইন ও ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা রয়টার্সকে বলেছেন, ইকুয়েডরের ব্যাংকের সঙ্গে মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সমঝোতার বিষয়টি বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত হিসেবে নিতে পারে।

নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির সময় হ্যাকারদের কাছ থেকে পাওয়া পেমেন্ট ম্যাসেজের মাধ্যমে এসেছিল সুইফট কোডে। চুরির পর বাংলাদেশ নিউইয়র্ক ফেডারেল ব্যাংক ও সুইফটের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছিল। তবে পরে প্রতিষ্ঠান দুটি বাংলাদেশ ব্যাংককে অর্থ ফেরত পেতে সহযোগিতার আশ্বাস দিলে সম্পর্ক উষ্ণ হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যাংকিং চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তিতে প্রত্যেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইফটের ব্যবস্থাপনায় আস্থাশীল বলে স্বীকার করে নেয়। আর সুইফট ব্যবহার করে ওই অর্থের বেশিরভাগ অংশ আরসিবিসিকে পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। বাংলাদেশ এখন আরসিবিসির বিরুদ্ধে মামলার পদক্ষেপ নিচ্ছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ ফেরত পেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তিনি রয়টার্সকে বলেছিলেন, এটা নিশ্চিত যে, আমরা মামলা করব। বাংলাদেশে এটা নিয়ে হতাশা আছে। তবে একসঙ্গে আমরা সবাই মিলে এখন ভালো কিছুর প্রত্যাশা করছি।

সাইবার আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারের সুযোগ কতটুকু; তা খতিয়ে দেখতে গিয়ে রয়টার্স বলছে, মার্কিন আইনে বলা হয়েছে কোনো ব্যাংকের চুরির মতো প্রতারণার দায় ততক্ষণ পর্যন্ত সেবাগ্রহীতার যতক্ষণ না তারা প্রমাণ করতে পারছে যে, অর্থছাড় করা সংক্রান্ত বার্তা যাচাইয়ে, তাদের মধ্যে সম্মতিসূচক কোনো চুক্তি আছে। তেমন কোনো চুক্তি থাকলেই কেবল এ কোডের আওতায় গ্রহীতার বলার সুযোগ থাকত যে, নিরাপত্তা চুক্তিটি বাণিজ্যিকভাবে তাদের জন্য ন্যায্য হয়নি। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে আরসিবিসির তেমন কোনো চুক্তি ছিল বলে এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।

এমইউএইচ/এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

আরও পড়ুন