ব্যাংকের প্রভাব শেয়ারবাজারে
এক ধরনের দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের ব্যাংক খাত। ব্যাংকের এ দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হলেও তার খুব একটা ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতেই ২০১৭ সালের সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন ও লভ্যাংশ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংক। শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ব্যাংক কোম্পানিগুলোর ঘোষিত লভ্যাংশেও দুরবস্থার চিত্র উঠে এসেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের শেয়ারবাজারে। ফলে দেখা দিয়েছে টানা দরপতন।
তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২০১৭ সালের সমাপ্ত বছরে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২৮টি ব্যাংক। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে এবার লভ্যাংশ না দেয়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে এবি ব্যাংক। আর লভ্যাংশ দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শুধু বোনাস শেয়ার দেয়ার তালিকায় এবার এমন ১০টি ব্যাংক রয়েছে যারা আগের বছর শুধু নগদ অথবা নগদ ও বোনাস উভয় লভ্যাংশ হিসেবে দিয়েছিল। এছাড়া নগদ লভ্যাংশ দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৫টি এবার গত বছরের তুলনায় কম নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। আর গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবার দু’টি ব্যাংক শুধু বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দিলেও পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।
লভ্যাংশের বিষয়ে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত আসতে থাকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে। মে মাস আসার আগেই তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংক লভ্যাংশের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে। ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশের সিদ্ধান্ত প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই শেয়ারবাজারে দরপতন দেখা দেয়। সর্বশেষ গত ২৬ এপ্রিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক কিছুটা বাড়ে।
এরপর ১০ কার্যদিবস পার হলেও মঙ্গলবার পর্যন্ত সূচকটি আর ঊর্ধ্বমুখী হয়নি। অর্থাৎ টানা ১০ কার্যদিবস শেয়ারবাজার পতনের মধ্যে রয়েছে। এই কার্যদিবসগুলোতে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ২৬৫ পয়েন্ট। লেনদেন কমে ৩’শ কোটি টাকার ঘরে চলে এসেছে। আর টানা দরপতনের কারণে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১০ হাজার ৬২১ কোটি টাকা।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক কোম্পানিগুলোর খারাপ লভ্যাংশ ঘোষণার কারণেই শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকগুলো যে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে তাতে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। একদিকে ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার পরিমাণ কমেছে, অন্যদিকে কিছু কোম্পানি নগদ লভ্যাংশের পরিবর্তে আশঙ্কাজনকহারে বোনাস শেয়ার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে বাজারে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে এবং বাজারে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে দেখা দিয়েছে টানা দরপতন।
তারা বলছেন, চীনের দুই প্রতিষ্ঠান শেনঝেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ কনসোর্টিয়ামকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে পাওয়া দেশের শেয়ারবাজারের জন্য বিরাট সুখবর। কিন্তু এ সুখবর আশার পরও শেয়ারবাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। আবার সরকার থেকে ব্যাংকগুলোর তারল্য বাড়াতে বিশেষ সুবিধা দেয়া হলেও ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ায়নি। ফলে শেয়ারবাজারে যে তারল্য সংকট ছিল তা রয়েই গেছে।
আগের বছর নগদ লভ্যাংশ দিলেও এবার শুধু বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দেয়া ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক। নগদ লভ্যাংশ কম দেয়ার তালিকায় আছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, আল-আরাফাহ ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক এবং দি সিটি ব্যাংক। আর বোনাস লভ্যাংশ কম দেয়ার তালিকায় রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক।
ব্যাংকের লভ্যাংশের চিত্র :ব্যাংকের নাম ২০১৭ সালের লভ্যাংশ ২০১৬ সালের লভ্যাংশপ্রাইম ব্যাংক ৭ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস ১৬ শতাংশ নগদপ্রিমিয়ার ব্যাংক ১৫ শতাংশ বোনাস ১০ শতাংশ নগদ ও ২ শতাংশ বোনাসব্যাংক এশিয়া ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ বোনাস ১২ শতাংশ বোনাসরূপালি ব্যাংক ২৪ শতাংশ বোনাস ১০ শতাংশ বোনাসমার্কেন্টাইল ব্যাংক ১৭ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস ১৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাসমিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ বোনাস ১৫ শতাংশ বোনাসওয়ান ব্যাংক ১৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস ১৩ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাসব্র্যাক ব্যাংক ২৫ শতাংশ বোনাস ১০ শতাংশ নগদ ও ২০ শতাংশ বোনাসযমুনা ব্যাংক ২২ শতাংশ বোনাস ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ নগদন্যাশনাল ব্যাংক ১২ শতাংশ বোনাস ২০ শতাংশ বোনাসদি সিটি ব্যাংক ১৯ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস ২৪ শতাংশ নগদপূবালী ব্যাংক ১০ শতাংশ বোনাস ৫ শতাংশ নগদ ও ৮ শতাংশ বোনাসএনসিসি ব্যাংক ১৩ শতাংশ নগদ ১৬ শতাংশ নগদডাচ-বাংলা ব্যাংক ৩০ শতাংশ নগদ ৩০ শতাংশ নগদএক্সিম ব্যাংক ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ নগদ ১৫ শতাংশ নগদশাহজালাল ইসলামি ব্যাংক ১০ শতাংশ বোনাস ১০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাসইস্টার্ন ব্যাংক ২০ শতাংশ নগদ ২০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাসট্রাস্ট ব্যাংক ২০ শতাংশ নগদ ১৫ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাসস্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১০ শতাংশ বোনাস ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাসআইএফআইসি ব্যাংক ১২ শতাংশ বোনাস ১২ শতাংশ বোনাসঢাকা ব্যাংক ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ বোনাস ১০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাসআল-আরাফাহ ব্যাংক ১৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস ২০ শতাংশ নগদসাউথইস্ট ব্যাংক ১৫ শতাংশ বোনাস ২০ শতাংশ নগদউত্তরা ব্যাংক ২০ শতাংশ নগদ ২০ শতাংশ নগদইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ১০ শতাংশ নগদ ১৫ শতাংশ নগদফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১০ শতাংশ বোনাস ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাসইসলামী ব্যাংক ১০ শতাংশ নগদ ১০ শতাংশ নগদস্যোশাল ইসলামী ব্যাংক ১০ শতাংশ বোনাস ২০ শতাংশ নগদএবি ব্যাংক শূন্য ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ বোনাসআইসিবি ইসলামিক ব্যাংক শূন্য শূন্য
ডিএসইর পরিচালক শরিফ আতাউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কি কারণে এমন টানা দরপতন হচ্ছে বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ উদঘাটনে আমাদের বসতে হবে। তবে ব্যাংক কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার একটি প্রভাব আছে বলে মনে হচ্ছে। ব্যাংকগুলো এবার শেয়ারহোল্ডারদের জন্য খুব একটা ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক জাগো নিউজকে বলেন, বাজারে যে টানা দরপতন দেখা দিয়েছে, এর মূল কারণ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত লভ্যাংশ দিতে পারেনি। ফলে বাজারে এক ধরনের তারল্য সংকটও দেখা দিয়েছে। যে কারণে চীনা কনসোর্টিয়ামের কৌশলগত বিনিয়োগকারী হওয়ার সুখবরের প্রভাবও বাজারে দেখা যাচ্ছে না।
ডিএসইর সাবেক পরিচালক শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন থাকবেই, এটা স্বাভাবিক নিয়ম। এখন শেয়ারবাজারে তেমন কোনো সমস্যা নেই। তবে ব্যাংকগুলো ভালো লভ্যাংশ না দেয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। টানা দরপতনের জন্য এটি একটি কারণ। কারণ ব্যাংকগুলো আমাদের শেয়ারবাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এমএএস/ওআর/আরআইপি