কার্যকর করারোপের অভাবে তামাকপণ্যের প্রকৃত দাম বাড়েনি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:৫৬ পিএম, ০৩ মে ২০১৮

কার্যকরভাবে কর আরোপের মাধ্যমে তামাকের দাম বাড়ালে তামাক ব্যবহার সন্তোষজনকহারে হ্রাস পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, করারোপের ফলে তামাকের প্রকৃত মূল্য ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে তামাকের ব্যবহার ৫ শতাংশ হ্রাস পায়, যা জনস্বাস্থ্যের নিরিখে প্রশংসনীয় সূচক হিসেবে বিবেচিত।

কিন্তু বাংলাদেশে তামাক কর বিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কার্যকর করারোপের অভাবে এখানে তামাকপণ্যের প্রকৃত মূল্য বৃদ্ধি পায়নি। উল্টো সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে তামাকের দাম সস্তা থেকে সস্তাতর হয়েছে।

এমনটিই দাবি দেশের তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর। তারা জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাকের ব্যবহার হ্রাস করতে আসন্ন ২০১৮-১৯ বাজেটে তামাকপণ্যে যুগোপযোগী এবং কার্যকর করারোপের দাবি জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘কেমন তামাক কর চাই’ শীর্ষক প্রাক-বাজেট সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানানো হয়। প্রজ্ঞা ও অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স-আত্মা’র উদ্যোগে তামাকবিরোধী সংগঠন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, ঢাকা আহছানিয়া মিশনসহ আরও কয়েকটি সংগঠন সম্মিলিতভাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব) আব্দুল মালিকের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক, ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের বাংলাদেশ কান্ট্রি এ্যাডভাইজার শফিকুল ইসলাম, আত্মার সহ-আহ্বায়ক নাদিরা কিরণ প্রমুখ।

আত্মার সহ-আহ্বায়ক নাদিরা কিরণ লিখিতভাবে তাদের বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন। প্রস্তুবগুলো হচ্ছে
১. সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা দুইটিতে (নিম্ন এবং উচ্চ) নামিয়ে আনা।
নিম্নস্তরের সিগারেটে করারোপের ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভাজন তুলে দেয়া এবং উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরকে একত্রিত করে একটি মূল্যস্তরে (উচ্চস্তর) নিয়ে আসা; নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা এবং উচ্চস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য ১০০ টাকা নির্ধারণ করে ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং সব ক্ষেত্রে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটে ৫ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা।

২. ফিল্টার এবং নন-ফিল্টার বিভাজন বাতিল করে প্রতি ২৫ শলাকা বিড়ির সর্বনিম্ন মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণ। বিড়ির ক্ষেত্রে ফিল্টার এবং নন-ফিল্টার বিভাজন বিলুপ্ত করা; প্রতি ২৫ শলাকা বিড়ির সর্বনিম্ন মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক এবং ৬ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা। বর্তমান সরকারের গৃহীত নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সহজলভ্যতার কারণে এখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোক্তা এর ব্যবহারের সুযোগ নেয় এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

৩. ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের (জর্দা ও গুল) এক্স-ফ্যাক্টরি প্রাইস প্রথা বিলুপ্তকরণ। এক্স-ফ্যাক্টরি প্রাইস প্রথা বিলুপ্ত করে সিগারেট ও বিড়ির ন্যায় খুচরা মূল্যের ভিত্তিতে করারোপ করা; প্রতি ২০ গ্রাম ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের সর্বনিম্ন মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক এবং ১০ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে বিড়ির উপর কর নির্ধারণের ভিত্তি ‘ট্যারিফ ভ্যালু’ প্রথা বাতিল করে ‘খুচরা মূল্য’ পদ্ধতি চালু করায় সরকার প্রায় ২৯৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করবে। আমাদের দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষত নারীদের মাঝে এই পণ্য ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে জর্দা-গুল ব্যবহারের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
৪. সব তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য থাকবে।

সংবাদ সম্মেলনে বেশকিছু সুপারিশমালাও তুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে
১.দীর্ঘমেয়াদে তামাকপণ্যের উপর করারোপে এড ভ্যালোরেম প্রথার পরিবর্তে কেবল সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ ট্যাক্স পদ্ধতির প্রচলন করতে হবে।
২.তামাক কর ব্যবস্থা সহজ করতে
ক. পর্যায়ক্রমে সব তামাকপণ্য অভিন্ন পরিমাণে (শলাকা সংখ্যা এবং ওজন) প্যাকেট/কৌটায় বাজারজাত করতে হবে
খ. একক মূল্যস্তর প্রথা প্রচলনের জন্য সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা কমিয়ে আনা
গ. তামাকপণ্যের মধ্যে কর এবং মূল্য পার্থক্য কমিয়ে আনা
ঘ. এড ভ্যালোরেম পদ্ধতি তুলে না দেয়া পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ ট্যাক্সের অংশ ক্রমশ বৃদ্ধি করা
৩. আয় বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ ট্যাক্স নিয়মিত বৃদ্ধি করা
ক. একটি সহজ এবং কার্যকর তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন (৫ বছর মেয়াদি) করতে হবে, যা তামাকের ব্যবহার হ্রাস এবং রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
৪. সকল প্রকার ই-সিগারেট এবং হিট-নট-বার্ন (আইকিউওএস) তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি এবং বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা।
৫. কঠোর লাইসেন্সিং এবং ট্রেসিং ব্যবস্থাসহ তামাক কর প্রশাসন শক্তিশালী করা, কর ফাঁকির জন্য শাস্তিমূলক জরিমানার ব্যবস্থা করা।
৬. তামাকের চুল্লি প্রতি বাৎসরিক ৫ হাজার টাকা লাইসেন্সিং ফি আরোপ করা।
৭. আদায়কৃত অতিরিক্ত রাজস্ব থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ অসংক্রামক রোগ মোকাবিলায় অর্থায়ন করা। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বৃদ্ধি (২%) একটি অন্যতম কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে।

এমইউএইচ/ওআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।