ব্যাংকের ফায়দা হাসিলের হাতিয়ার শেয়ারবাজার!

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:১৫ এএম, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

ব্যাংক কোম্পানির মালিক ও নির্বাহীরা নিজেদের ফায়দা হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে দেশের শেয়ারবাজারকে ব্যবহার করছেন। আর শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ব্যাংকের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন। এতে শেয়ারবাজারে সাময়িক ইতিবাচক প্রভাব দেখা দিলেও, তা স্থায়ী হচ্ছে না। তবে শেয়ারবাজার এবং বাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনকে ব্যবহার করে ব্যাংক ঠিকই ফায়াদা হাতিয়ে নিচ্ছে- এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

তারা বলছেন, সম্প্রতি সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ হাতিয়ে নেয়া এবং নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) হার কমানোর হাতিয়ার হিসেবে শেয়ারবাজারকে বেছে নেয় ব্যাংক মালিক ও নির্বাহীরা। তাদের অদৃশ্য ইঙ্গিতে শেয়ারবাজারে টানা দরপতন দেখা দেয়। তারল্য সংকট ও বিনিয়োগ সমন্বয়ের নামে শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায় বিভিন্ন ব্যাংক। ফলে শেয়ারবাজারে একপ্রকার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং দেখা দেয় টানা দরপতন। একপর্যায়ে শেয়ারবাজারের ‘স্বার্থে’ ব্যাংকের জন্য বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করে সরকার।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু জাগো নিউজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে যে সুবিধা দেয়া হয়েছে তার কোনো সুফল শেয়ারবাজারে পড়বে বল আমার মনে হয় না। মূলত শেয়ারবাজার ব্যবহার করে ব্যাংক সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে।’

শেয়ারবাজার ব্যবহার করে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্ন করা হলে ডিএসইর সাবেক পরিচালক শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, ‘শেয়ারবাজার ব্যবহার করে ব্যাংক কিছুটা সুবিধা নিয়েছে এটা ঠিক। আমি মনে করি, খেলাপি ঋণ কমাতে হলে পলিসি পরিবর্তন করতে হবে। শিল্পের জন্য ব্যাংক ঋণ পরিহার করে শেয়ারবাজার ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সীমার বেশি ঋণ নিতে হলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। এটি করতে পারলে সব খাতই সুবিধা পাবে।’

অবশ্য ব্যাংক খাতের জন্য সরকারের বিভিন্ন ছাড়ের কারণে শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন চৌধুরী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতকে ছাড় দেয়ার কারণে শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সূচক কমে যাওয়া কোনো ব্যাপার নয়।’

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বিশেষ সুবিধা দেয়ার আগে টানা দরপতন দেখা দেয়ায় দফায় দফায় বৈঠকে বসেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর নেতারা। সেসব বৈঠকে ঘুরে-ফিরে উঠে আসে ব্যাংকের তারল্য সংকট। অবশ্য ব্যাংক খাতের প্রভাবশালীরা তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিজেদের প্রতিনিধি মার্চেন্ট ব্যাংকের নির্বাহীদের মাধ্যমে তারল্য সংকটের তথ্য তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে মার্চেন্ট ব্যাংকের নেতারা শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হন যে, ব্যাংকের তারল্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হলে শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ফিরে আসবে।

ফলে ব্যাংকের তারল্য বাড়ানোর দাবিতে রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়েন শেয়ারবাজারের নেতারা। অর্থ মন্ত্রণালয়ে দাবি জানানোর পাশাপাশি একাধিক সংবাদ সম্মেলনও করে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) ও ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ)। সব ক্ষেত্রেই তারা দাবি করেন যে, ব্যাংকের তারল্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হলে শেয়ারবাজারের সংকট কেটে যাবে। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের এমন দৌড়ঝাঁপে জোরালো হয় ব্যাংক মালিক ও নির্বাহীদের দাবি।

একপর্যায়ে ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বসে অর্থ মন্ত্রণালয়। মার্চের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত এমন এক বৈঠক থেকে ঘোষণা আসে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে রাখা হবে, যা এতোদিল ছিল ২৫ শতাংশ। এরপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রাজধানীর একটি হোটেলে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা এস কে সুর চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে ব্যাংক মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সিআরআর কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী জানান, ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ সাড়ে ছয় শতাংশ থেকে এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে পাঁচ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর সুদের হার কমানোর অংশ হিসেবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত ৫০ শতাংশ রাখা হবে। ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। অর্থমন্ত্রীর ওই ঘোষণার পর সিআরআর কমানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অবশ্য ব্যাংক খাতের জন্য সরকারের দেয়া সিদ্ধান্তের প্রথম থেকেই বিরোধিতা করে আসছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিআরআর কমানোর সিদ্ধান্ত অনাকাঙ্খিত এবং অপ্রয়োজনীয়। এতে আর্থিক খাতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাবে। কারণ হয়তো দু-চারটি ব্যাংকের তারল্য সংকট থাকতে পারে। কিন্তু সার্বিকভাবে ব্যাংকিং সিস্টেমে কোনো তারল্যের সংকট নেই, বরং মিনিমাম যেটা থাকার কথা তার থেকে বেশি আছে।’

সাম্প্রতিক সময়ে টানা দরপতনের কারণ সম্পর্কে ডিএসইর সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, ‘নির্বাচনের বছর হওয়ায় এ বছর কিছুটা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। সুতরাং নির্বাচনের আগ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন একটু বেশিই থাকবে। এছাড়া সরকার থেকে ব্যাংকের জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়া হলেও সুদের হার এখনও কমেনি। সুদের হার বেশি থাকা এবং ব্যাংক খাতের ওপর আস্থাহীনতাও দরপতনের কারণ।’

তবে সম্প্রতি শেয়ারবাজারে টানা দরপতন দেখা দিলেও তা স্বাভাবিক বলে মনে করছেন বিএমবিএ সভাপতি মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এখন যে দরপতন দেখা দিয়েছে তা নরমাল ট্রেড (স্বাভাবিক প্রক্রিয়া)। এখানে আমরা অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না। শেয়ারবাজারে সূচক কমবে আবার বাড়বে- এটাই নিয়ম।’

নির্বাচনের বছর হওয়ার কারণে বাজারে উত্থান-পতন বেশি হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্ন করা হলে বিএমবিএ’র এ নেতা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। তবে একটি পক্ষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবে এবং একটি পক্ষ বিনিয়োগ উঠিয়ে নেবে, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।’

ডিএসইর সাবেক পরিচালক শাকিল রিজভী সাম্প্রতিক সময়ের দরপতনের কারণ হিসেবে বলেন, ‘ব্যাংকের জন্য সরকারের বিশেষ সুবিধা ঘোষণার পর শেয়ারবাজার যেভাবে বেড়েছে তা স্বাভাবিক ছিল না। যে কারণে এখন দরপতন দেখা দিয়েছে। এর পাশাপাশি বাজারে যে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছিল তার প্রভাব এখনও রয়ে গেছে। ব্যাংকের সুদের হার এখনও কমেনি। এরও একটি নেতিবাচক প্রভাব বাজারে আছে।’

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের প্রফিট টেকিংয়ের (মুনাফা তুলে নেয়া) কারণে কিছুটা দরপতন দেখা দিয়েছে। এটি স্বাভাবিক দরপতন। এতে বিনিয়োগকারীদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’

ব্যাংকের জন্য সরকারের দেয়া সুবিধা শেয়ারবাজারে কতটা সুফল এনেছে- এমন প্রশ্ন করা হলে তার কোনো উত্তর দেননি ডিএসইর ব্রোকারদের এ নেতা।

এমএএস/এমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।