কর্তাদের হস্তক্ষেপে চাপা পড়ছে ব্যাংকের অনিয়ম
পরিচালনা পর্ষদ ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি চাপা পড়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটরিয়ামে ‘ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স অব ব্যাংকস’ শীর্ষক কর্মশালায় বক্তারা এ অভিযোগ করেন।
কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও বিআইবিএমের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। এছাড়া ঢাকা ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলী, এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহমুদ হুসাইন এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এফ এম শরিফুল ইসলাম বক্তব্য দেন।
বক্তারা বলেন, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার ওপর অনেক কিছুই জড়িত। এজন্য আইসিসি (ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স) বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। অডিট কর্মকর্তাদের তদন্তে অনেক বিষয় উঠে আসলেও তা সবসময় রিপোর্ট করা যায় না। আবার অনেক সময় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামতে নির্দোষ ব্যক্তিকেও দোষী করে রিপোর্ট করা হয়। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একা কিছুই করতে পারবে না। তাই সরকারসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, টেকসই ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৩ সালে কোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে একটি গাইডলাইন করেছিল, যা এখন প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা প্রতিনিয়তই উন্নত করা হচ্ছে। পাশাপাশি অনলাইন মনিটরিংও করা হচ্ছে।
কর্মশালায় ঢাকা ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি এবং সাম্প্রতিক ফরমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে যেসব দুর্নীতি-অনিয়ম হয়েছে তার প্রধান কারণ সঠিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঘাটতি। এক্ষেত্রে ব্যাংকের আইসিসিডি (ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স ডিপার্টমেন্ট) বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে।
তিনি বলেন, কমপ্লায়েন্স এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবে ব্যাংকিং খাতের এই দুরবস্থা। ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। ব্যাংকিং খাতের এই অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে পরিচালনা বোর্ড, ম্যানেজমেন্ট এবং শাখা ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে সৎ, যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত জনশক্তি প্রয়োজন।
কর্মশালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলী ব্যাংক পরিচালকদের প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, এখন যদি বলা হয় যে, পরিচালকদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে, তাহলে ব্যাপক হৈচৈ পড়ে যাবে। কিন্তু এটা করা উচিত। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে ভাবতে হবে। যেকোনোভাবে পরিচালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকগুলোর ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগকে স্বাধীনভাগে কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে ভূমিকা রাখতে হবে। আইসিসিডিতে কাজ করার জন্য কর্মকর্তাদের আলাদাভাবে ইনসেনটিভ দিতে হবে।
ইয়াছিন আলীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, আমিও এটা মনে করি যে, ব্যাংকের পরিচালকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটা খুবই প্রয়োজন।
এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেহমুদ হোসাইন বলেন, সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এবং পরিচালনা বোর্ড ঠিক হলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এখানে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এবং পরিচালনা বোর্ডের টোন অব দ্য টক বুঝতে হবে। অডিট কমিটি এবং সিনিয়র ম্যানেজমেন্টকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, বছর শেষে ব্যাংকগুলো যে মুনাফা বাড়ানোর চিন্তায় থাকে বা মুনাফার টার্গেট করা হয়, এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেননা, ব্যাংকিং বিজনেস হলো জেনারেশন বিজনেস। এটা শর্টটাইম বিজনেস না। বছর শেষে মুনাফা বাড়াতে গিয়ে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং কমপ্লায়েন্স রক্ষা করতে পারে না ব্যাংকগুলো।
ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এফ এম শরিফুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের প্রধান ঝুঁকিই হলো ক্রেডিট রিস্ক। আইসিসিডিতে মেধাবী কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া কর্মকর্তারা এই বিভাগে কাজ করতে যাতে আগ্রহী হয়, তার জন্য তাদের ইনসেনটিভ দিতে হবে।
কর্মশালায় বিআইবিএমের অধ্যাপক ও পরিচালক মো. মহিউদ্দিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত এ খোদা।
এসআই/এমএ/জেডএ/জেআইএম