শেয়ার কেলেঙ্কারি : রকিবুরসহ ৩ আসামি খালাস
শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক রকিবুর রহমানসহ তিন আসামি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। সম্প্রতি শেয়ারবাজার বিষয়ক বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক আকবর আলী শেখ এ রায় দেন।
খালাস পওয়া অপর দুইজন হলেন- টি কে গ্রুপের মালিক আবু তৈয়ব এবং বুলবুল সিকিউরিটিজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম শহিদুল হক বুলবুল।
চিটাগাং সিমেন্টের (বর্তমানে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট) শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এ তিনজনের পাশাপাশি কোম্পানিকেও আসামি করা হয়। রায়ে কোম্পানিকেও অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির অভিযোগে মামলা করেছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। মামলার অন্যতম আসামি রকিবুর রহমান থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছিল ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধস উৎঘাটনে গঠিত তদন্ত কমিটি।
খালাস দেয়ার রায়ে বিচারক আকবর আলী শেখ বলেন, রকিবুর রহমান ও এ এস এম শহিদুল হক বুলবুল সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্দেশনা অমান্য করে চিটাগাং সিমেন্টে পদ ধরে রাখেনি। আর স্টক এক্সচেঞ্জ ছাড়া বিদেশিদের কাছে শেয়ার বিক্রির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। অভিযুক্তরা তাদের আত্মীয়দের কাছে বিপুল পরিমাণ শেয়ার হস্তান্তর করেছে এমন অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি। এছাড়া দুই কোটি ৯২ লাখ টাকা মূল্যের দুই হাজার ২৪০টি শেয়ার দীর্ঘদিন ফরেন অ্যাকাউন্টে আনসেটেলট অবস্থায় থাকার দায়ভার আসামিদের উপর বর্তায় না।
সর্বোপরি আসামিরা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯ এর ১৭ ধারা লংঘন করে ১৯৯৬ সালে (জুলাই-ডিসেম্বর) শেয়ার কেনা-বেচায় কোনো ধরনের কারসাজিমূলক কাজ করেনি বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেছেন।
এর আগে যুক্তি-তর্ক শেষে ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের বিচারক হুমায়ুন কবীর রায় ঘোষণার জন্য ওই বছরের ৮ নভেম্বর দিন নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু রায় ঘোষণার মাত্র ৫ দিন আগে ৩ নভেম্বর মামলাটির কার্যক্রমের ওপর উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ দেয়া হয়।
এ মামলার অন্যতম আসামি বুলবুল সিকিউরিটিজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম শহিদুল হক বুলবুলের রিটের প্রেক্ষিতে ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন আদালত। ফলে মামলার রায় ঘোষণা করতে পারেননি ট্রাইব্যুনালের বিচারক। পরে কয়েক দফায় মামলাটির স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
এদিকে মামলা স্থগিত থাকাকালীন ২০১৬ সালের ১২ জুলাই বিচারক হুমায়ুন কবীর অন্যত্র বদলি হন। এরপর ১৪ জুলাই ট্রাইবুন্যালে নতুন বিচারক হিসেবে যোগদান করেন আকবর আলী শেখ।
কয়েক দফায় স্থাগিতাদেশের আবেদন করা এ এস এম শহিদুল হক নিজেই মামলা চালুর জন্য উচ্চ-আদালতে আবেদন করেন। এর আলোকে ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে মামলা চালুর নির্দেশ দেয় উচ্চ-আদালত।
উচ্চ-আদালতের নির্দেশে ট্রাইবুন্যালে মামলাটি ফের চালু হয়। তবে বিচারক হূমায়ন কবীরের সময় মামলাটির রায় ছাড়া সব কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায়, নতুন বিচারপতি শুধু বাদী ও বিবাদীর যুক্তি শোনেন এবং পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ৩০ মে বিচারক আসামিদের বেকসুর খালাস দেন।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনজীবী মাসুদ রানা খান বলেন, আসামিদের বেকুসুর খালাস দেয়ায় আমরা সঠিক বিচার পাইনি বলে মনে করি। যে কারণে আমরা উচ্চ-আদালতে আপিল করেছি।
মামলার সাক্ষী ছিলেন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক জহিরুল হক, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মনিরউদ্দিন আহমেদ, সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা এম এ রশীদ খান ও চিটাগাং সিমেন্টের সাবেক সচিব মোস্তাফিজুর রহমান। আর সাক্ষীর পাশাপাশি বাদী ছিলেন এম এ রশীদ খান।
এদিকে আসামি আবু তৈয়বের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন ও শেখ মোহাম্মদ আলী। আর রকিবুর রহমান ও এ এস এম শহিদুল হক বুলবুলের পক্ষে ছিলেন মোহাম্মদ মহসিন রশিদ, মো. নূরুল ইসলাম মোল্লা ও এম এ কাদের মোল্লা।
অপরদিকে বিএসইসি বা বাদীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মাসুদ রানা খান ও আব্দুল্লাহ এম রফিকুল ইসলাম।
মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা ১৯৯৬ সালে চিটাগাং সিমেন্টের পরিচালক ছিলেন। ভারতীয় ও ইরানি বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির শেয়ার কিনবে বলে আসামিরা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছড়িয়ে শেয়ার মূল্য প্রভাবিত করেন। এ ব্যাপারে পরবর্তীকালে চিটাগাং সিমেন্টের পক্ষে সন্তোষজনক কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
এরপর কোম্পানির একজন পরিচালক বড় অঙ্কের শেয়ার হস্তান্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে কী পরিমাণ ও কোন ব্যক্তি এ কাজ করেছেন তা ৯৬ সালের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।
এছাড়া বিএসইসির নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও রকিবুর রহমান এবং এ এস শহিদুল হক বুলবুল পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স-১৯৬৯ এর ১৭ ধারা অনুসারে কারসাজি বলে মনে করে গঠিত তদন্ত কমিটি।
শেয়ার কারসাজির ঘটনা উদঘাটনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আমিরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তিন মাস পর ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ তদন্ত কমিটি সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনে চিটাগাং সিমেন্টের শেয়ার কারসাজির বিষয়টি উঠে আসে। আর এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালের ৪ মে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে মামলা করে বিএসইসি। মামলাটি পরবর্তীকালে বিচারের জন্য প্রথম অতিরিক্ত দায়রা আদালত ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। এই আদালতে থাকাকালীন মামলাটির বাদীর সাক্ষ্য শেষ হয়।
পরে মামলার আদালত পরিবর্তনের নির্দেশ এলে বাদী পক্ষের সম্মতিতে নিম্ন আদালতের আদেশের ওপর স্থগিতাদশে দেন উচ্চ আদালত। এরপর বিএসইসির ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মামলাটি এই আদালতে স্থানান্তর করা হয়।
এমএএস/এএইচ/এমবিআর/আরআইপি