আর্থিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কটের আশঙ্কা

মেসবাহুল হক
মেসবাহুল হক মেসবাহুল হক , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:২১ পিএম, ১৭ মার্চ ২০১৮

বাজেট ঘাটতি মেটানোসহ নানা প্রয়োজনে বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করে সরকার। এর মধ্যে ট্রেজারি বিল ও বন্ড ইস্যু অন্যতম। কিন্তু সুদের হার বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত হারে বিক্রি হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। ফলে সরকার স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে সব ধরনের ট্রেজারি বন্ড ও বিল বিক্রি কার্যক্রম। এতে করে ট্রেজারি সিকিউরিটিজের সেকেন্ডরি মার্কেট তথা বন্ড মার্কেট উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পাশাপাশি প্রাইমারি ডিলার ব্যাংকগুলোতে (যেসব ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেয়) তারল্য ব্যবস্থাপনায় জটিলতা সৃ্ষ্টি হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের কারণে ব্যয় বৃদ্ধিসহ ব্যাহত হচ্ছে ঋণ ব্যবস্থাপনার মূলনীতি। যার কারণে দেশের আর্থিক খাতে বড় ধরনের সঙ্কটের আশঙ্কা করছে খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়।

আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদহার বেশি থাকার ফলে ব্যাংক থেকে আমানতকারীরা টাকা তুলে নিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। এতে করে ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার বেশকিছুটা কমে গেছে। আমানত কমে গেলে বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে পারবে না ব্যাংকগুলো। এতে করে বিনিয়োগ আরও কমে যাবে। নতুন করে কর্মসংস্থানও হবে না। পাশাপাশি দারিদ্র বিমচনের যে অগ্রগতি সেটা বিঘ্নিত হবে। তাই সঞ্চয়পত্র নীতিমালা ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি সরকারের ঋণ পোর্টফোলিও (ঋণ তহবিল), ব্যয় ও ঝুঁকির ওপর বিশ্লেষণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। এ বিশ্লেষণের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছর হতে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত সরকারের অভ্যান্তরীণ ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতের ঋণ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে গৃহীত ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সঞ্চয়পত্র হতে গৃহীত ঋণ ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের ৩৪ শতাংশ হতে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। পাশাপাশি একই সময়ে ব্যাংকিং খাতের গৃহীত ঋণ ৬৬ শতাংশ হতে হ্রাস পেয়ে ৪৪ শতাংশ হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়েছে সঞ্চয়পত্রের অস্বাভাবিক বিক্রি অব্যাহত থাকায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিং খাত হতে ঋণ গ্রহণের পরিবর্তে ১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে। ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ না নেয়ায় ট্রেজারি সিকিউরিটিজের সেকেন্ডারি মার্কেট উন্নয়ন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। পাশাপাশি প্রাইমারি ডিলার ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। যার কারণে দেশের আর্থিক খাত বড় ধরণের সঙ্কটের সম্মুখীন হচ্ছে।

আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা বলছেন অধিকাংশ দেশে দুটি মার্কেট থাকে। তার একটি হচ্ছে শেয়ার মার্কেট, অন্যটি বন্ড মার্কেট। তাই শেয়ার মার্কেটে সমস্যা দেখা দিলে সাধারণ গ্রহকরা বন্ড মার্কেটে চলে যায়। আবার বন্ড মার্কেটে সমস্যা দেখা দিলে শেয়ার মার্কেটে চলে যায়। প্রত্যেক দেশে এ দুই মার্কেটই রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে শুধু শেয়ার মার্কেট রয়েছে তাই গ্রাহকরা শেয়ার মার্কেটে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বন্ড মার্কেটে যেতে পারেন না। এর জন্য বন্ড মার্কেট চাঙা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল কিন্তু সেগুলো অনেকাংশেই বাস্তবায়ন হয়নি।

অর্থ বিভাগের বিশ্লেষণে আরও বলা হয়, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদ (ইল্ড) অপেক্ষা সঞ্চয়পত্রের সুদ গড়ে ৫ শতাংশ বেশি হওয়ায় সরকারের সুদ বাবদ ব্যয় দ্রুত বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সুদ ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতের ঋণের সুদ ব্যয় পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ৬ শতাংশ কমেছে। পক্ষান্তরে জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্পসমূহ হতে গৃহীত ঋণের উপর সুদ বাবদ ব্যয় একই সময়ে ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ মেয়াদ ৫ বছর। অপরপক্ষে ট্রেজারি বন্ডের মেয়াদ ২ বছর হতে ২০ বছর। ফলশ্রুতিতে, দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ গ্রহণ কম ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হলেও এক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ গ্রহণেরর পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত স্বল্প মেয়াদি ঋণ অধিক সুদে গ্রহণের কারণে সরকারের ঋণ পোর্টফোলিওতে (ঋণ তোহবিল) ঝুঁকি ও ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করেছে যে, কম সুদে ব্যয়-সম্পন্ন ট্রেজারি সিকিউরিটিজের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণের সুযোগ থাকলেও উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। এতে করে সরকারি ঋণ ব্যবস্থাপনার মূলনীতি-ঋণের ব্যয় (সুদ) ও ঝুঁকি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার নীতি ব্যাহত হচ্ছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থ বিভাগের বিশ্লেষণটা অনেকাংশেই ঠিক। কারণ আমিও বহুদিন ধরে বলে আসছি সঞ্চয়পত্রে সুদের হার অনেক বেশি। বাজেটে সঞ্চয়পত্র কেনার একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা থাকে। তারপরও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বিক্রি করা হয়। ফলে সরকারের সুদের হার অনেক বেড়ে যায়। এতে করে অন্যান্য জরুরি খাত যেমন, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমে যায়। এটা হচ্ছে একটা খারাপ দিক’।

তিনি বলেন, ‘অন্য খারাপ দিক হচ্ছে সঞ্চয়পত্রে সুদহার বেশি খাকার ফলে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার অনেকটাই কমে গেছে। আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমলে ব্যাংকগুলো ঋণও কম দেবে। ঋণ কম দেয়া মানে সেটা আবার বিনিয়োগের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর বিনিয়োগ না হলে দেশে নতুন করে কর্মসংস্থান হবে না। পাশাপাশি দারিদ্র বিমচনের যে অগ্রগতি সেটা বিঘ্নিত হবে’।

তবে সঞ্চয়পত্রের বিষয়টা অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে দেখা হয় বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়।

এ বিষয়ে সাবেক এ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা একেবারেই ভোগাস কথাবার্তা। সঞ্চয়পত্র যথেষ্ট বিক্রি করা হয়েছে। যাদের বেশি অর্থ আছে তারাই বেশির ভাগ কিনছে। যদিও একটা পারিবারিক সিলিং রয়েছে তবে এগুলো মানা হয় না; বেনামে কেনে। কাজেই এক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির কিছুই কাজে আসে না’।

তিনি উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘বরগুনার একটা প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো মহিলা কি সঞ্চয়পত্র কেনে’?

উল্লেখ্য, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে সরকারের নেট ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা।, যা অর্থবছরের পুরো সময়ের লক্ষ্যমাত্রার ৯৬.০৬ শতাংশ। ঘাটতি বাজেট অর্থায়নে এই অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে সরকারের ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

এমইউএইচ/এমএমজেড/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।