রাজনীতির খপ্পরে শেয়ারবাজার

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রাজনীতির খপ্পরে পড়েছে দেশের শেয়ারবাজার। যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পুঁজিবাজারে ধস দেখা দিয়েছে। একটি চক্র রাজনৈতিক অস্থিরতার গুঞ্জন ছড়িয়ে শেয়ারবাজার থেকে ফায়দা নেয়ার পায়তারা চালাচ্ছে। তাদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের মালিকানাধীন কিছু ব্রোকারেজ হাউস ও একই মতাদর্শের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণাধীন মার্চেন্ট ব্যাংকও রয়েছে। আর এ চক্রকে শেয়ারবাজারে আতঙ্ক ছড়ানোর ক্ষেত্রে রসদ জুগিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত ৩০ জানুয়ারি ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ঋণ আমানতের অনুপাত (এডিআর) কমিয়ে আদেশ জারি করে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর এডিআর ৮৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর এডিআর ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৯ শতাংশ করেছে।

এই এডিআর কমানোর ঘোষণা আসার পর থেকেই শেয়ারবাজারে টানা পতন বিরাজ করছে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা দফায় দফায় বৈঠক করেও সেই পতন ঠেকাতে পারছেন না। বাজর সংশ্লিষ্টদের দাবি, নতুন মুদ্রানীতি বা এডিআর কমানো শেয়ারবাজারের পতনের মূল করণ নয়। পতনের মূল কারণ রাজনৈতিক আতঙ্ক।

গত কয়েকদিন বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ঘুরে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন মাধ্যমে গুঞ্জন ছড়ানো হযেছে ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায় কেন্দ্র করে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ওই দিন (৮ ফেব্রুয়ারি) সংঘাত না হলেও ২০ অথবা ২১ ফেব্রুয়ারি অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এমন রাজনৈতিক সংঘাতের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ায় অনেকে আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে বিক্রির চাপ বেড়ে যাওয়ায় শেয়ারবাজারে পতন ঘটছে।

এদিকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী মতাদর্শের একটি অংশের ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক রাজনৈতিক অস্থিরতার অজুহাতে নিজেদের পোর্টফোলিওতে শেয়ার ক্রয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি নতুন বিনিয়োগের জন্য আসা বিনিয়োগকারীদেরও নানাভাবে নিবৃত করছেন তারা। শেয়ারবাজরে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির অতঙ্ক ছড়িয়ে একদিকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল, অন্যদিকে স্বল্প দামে শেয়ার কিনতে চক্রটি এ কাজ করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের আগে থেকেই শেয়ারবাজারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পায়তারা চালো হচ্ছে। ২০১০ সালে এসে শেয়ারবাজার রাজনীতিকরণের চিত্র অনেকটাই প্রকাশ্য রুপ নেয়। ওই সময় সরকারকে বিপাকে ফেলতে আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি চক্র মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে। তাদের তৎপরতায় শেয়ারবাজর অস্বাভাবিক ফুলে-ফেপে উঠে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১০ সালের মহাধসের সময় বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে নিয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করতে একযোগে শেয়ার বিক্রি শুরু করে চক্রটি।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখ ওই চক্রটি আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ২০১৭ সলে চক্রটি শেয়ারবাজারে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে। তাদের সঙ্গে সরকারপন্থীরাও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে সক্রিয় হয়। ফলে ২০১৭ সালে বড় ধরণের উত্থান ঘটে। ভালো কোম্পানির সঙ্গে দুর্বল কোম্পানির দামও বাড়ে হু হু করে। চক্রটির টার্গেট ছিল আগামী জুলাই-আগস্টে একযোগে শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়ে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।

তবে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায় ৮ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত হওয়ার পর থেকেই বাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির পায়তারায় লিপ্ত হয় সরকার বিরোধীরা। এমন পরিস্থিতিতে ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এডিআর কমানোর নির্দেশনা জারি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনা তাদের তৎপরতাকে আরও উসকে দেয়। বাজারে ছড়ানো হয় বিভিন্ন ভিতিকর তথ্য। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় টানা দরপতন দেখা দেয় বাজারে। সোমবার পর্যন্ত টানা পাঁচ কার্যদিবস দরপতন হয়। এতে ডিএসইর প্রধান সূচক পড়ে যায় ৩০৭ পয়েন্ট।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, হঠাৎ দ্রুত গতিতে বাজার ১০০০-১২০০ পয়েন্ট বেড়েছে। এমন বাড়া স্বাভাবিক না। একটি গ্রুপ হয়তো এর মাধ্যমে প্রফিট করে চলে গেছে। আর এডিআর ১ শতাংশের মতো কমানোর কারণে বাজারে একটি বিরাট প্রভাব পড়বে এ রকম কোনো কারণ আমি দেখি না। আমার ধারণা কেউ হয়তো প্রচারণা চালাচ্ছে এই বাজার গেলো গেলো।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে একটি গোলযোগ হতে পারে এমন গুজবে এক-দুই দিন দরপতন হতে পারে। কিন্তু এমন দরপতন তো হওয়ার কারণ নেই। সেদিন যাই হোক, তার জন্য এখন থেকেই বাজারে প্রভাব পড়ার কারণ আমি দেখি না। তবে রাজনৈতিক ইস্যু ব্যবহার করে একটি চক্র গুঞ্জন ছড়িয়ে বাজার থেকে ফায়দা হাতিয়ে নেয়। খলেদা জিয়াকে যখন গ্রেফতার করা হয়, সেই দিনগুলোতেও বাজারে তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

ডিএসইর সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, ২০১৮ সাল হলো নির্বাচনী বছর, সুতরাং অনিশ্চয়তা। অনিশ্চয়তার সময় বাজার স্বাভাবিক থাকে না, এই বছর অনিশ্চয়তাটা অনেক বেশি। এই অনিশ্চয়তাটা হলো রাজনৈতিক। সবার অংশগ্রহণে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে এটা বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশেই বিশ্বাস করে না। এর সঙ্গে ব্যাংকের এডিআর কমানোর কারণে সুদের হার বেড়ে গেছে। এর একটি প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের ওপর মানুষের আস্থার সংকট রয়েছে।

এডিআর কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৮ সালে কোনো ধরণের নেগেটিভ রিফর্ম ভলো ফল বয়ে আনবে না। আমাদের অনেক জায়গায় উন্নয়ণ করা প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই। যারা সরকার সংশ্লিষ্ট তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকতে পারে এমনিই অনিশ্চয়তা, আপনারা নতুন করে অনিশ্চয়তা সৃষ্ট করেন না। অনিশ্চয়তার মধ্যে আরও অনিশ্চয়তা যোগ করলে তো যাওয়ার জায়গা থাকবে না।

এ বিষয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, পুঁজিবাজারে কোনো ধরনের সংকট নেই। এ সংকট কৃত্রিম এবং একটি ‘সার্টেন পয়েন্ট’ থেকে ছড়ানো হচ্ছে। শুধুমাত্র গুজবের ওপর বাজার পড়ে যাচ্ছে। গুজবটা অনেকটাই রাজনৈতিক।

বিএমবিএ’র মহাসচিব খায়রুল বাশার বলেন, সামনে দেশে কী যেন একটা হতে যাচ্ছে এমন একটি গুজবে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত। যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ৮ ফেব্রুয়ারি চলে গেলেই বুঝতে পারবেন আসলে কিছুই হয়নি।

বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলন, শেয়ারবাজারে পরিকল্পিতভাবে দরপতন ঘটানো হচ্ছে। ২০১০ সালে যে চক্র শেয়ারবাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ হাতিয়ে নেই, সেই চক্রই আবার বাজারে সংক্রিয় হয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবেই এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে।

এমএএস/এমবিআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।