ব্যাংকিং খাতে অনিয়মে দুশ্চিন্তায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:৩৫ এএম, ০২ জানুয়ারি ২০১৮

দিন দিন দুরবস্থায় পড়ছে দেশের ব্যাংকিং খাত। বেড়েই চলছে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি আর খেলাপি ঋণ। মালিকদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক চাপ, সুশাসনের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাত চলছে নানা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে। ব্যাংক পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ডুবতে বসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে মালিকদের নিয়ন্ত্রণ আর নানা কেলেঙ্কারিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোরও বেহাল দশা।

কিন্তু এসব ঘটনা ‘লোক-দেখানো কিছু পদক্ষেপ’ বলে অনেকটা নিশ্চুপ ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ব্যাংক খাতকে এ দুরবস্থা থেকে উদ্ধার ও পরিস্থিতি উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো শক্ত হতে হবে। অন্যথায় দিন দিন পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে কোথাও অনিয়ম দেখা দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে দাবি বাংলাদেশ ব্যাংকের।

দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি-বিদেশি মিলে মোট ৫৭টি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক অবস্থার কারণে অবনতিতে রয়েছে ১৪ ব্যাংক। আটটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংক। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিস্থিতি বেশ নাজুক।

এছাড়া এক যুগ আগে বিলুপ্ত হওয়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের দুর্নীতির বোঝা এখনো টেনে চলছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। বাকি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থাও খুব সন্তোষজনক নয়।

দেশের ৩০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতি ও অব্যবস্থাপনা খুঁজে পাওয়ায় সম্প্রতি জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সভায় ডেকে পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সভায় ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সতর্ক করে দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। পাশাপাশি তিনি কিছু দিকনির্দেশনাও দেন।

এসব অনিয়মের বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বেশকিছু ব্যাংক একের পর এক অনিয়ম করেই যাচ্ছে। আমাদের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও হাত-পা বাঁধা, কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। একটি ব্যাংকে দু-তিনবার নোটিশ দেয়ার পরও ঠিক হচ্ছে না। দুষ্টু লোকের ক্ষমতা অনেক বেশি।

তিনি আরো বলেন, আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলেই ওপর মহল থেকে ফোন আসে। অনেক কিছু জেনেও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি না। তাই আমরাও অনেক সময় দুশ্চিন্তায় থাকি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসান বলেন, ব্যাংকিং ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে আস্থার ওপর নির্ভরশীল। আস্থা ফেরাতে সুশাসন খুবই প্রয়োজন। কিন্তু আমরা অনেক সময় দেখছি, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। ফলে কিছু অনিয়মের অভিযোগও উঠছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতোমধ্যে অনিয়মের কারণে অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।

দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারিসহ মোট ৫৭টি ব্যাংক তফসিলি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ঋণ জালিয়াতি, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা আর অনিয়ম ঠেকাতে ১৪টি ব্যাংকে এরই মধ্যে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ছাড়া সবক’টিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এছাড়া বেসরকারি সাতটি ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এগুলো হলো- আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। তবে শৃঙ্খলা ফেরাতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। অধিকাংশ ব্যাংকের আর্থিক সূচকে উন্নতি নেই। সুশাসন ঘাটতিও দূর হয়নি।

জানা গেছে, মূলত পর্যবেক্ষকদের চোখে অনিয়ম ধরা পড়লেও রাজনৈতিক চাপে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। ফলে এসব ব্যাংকে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এমনকি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে কয়েকটি ব্যাংক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতা আর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে বাড়ছে অনিয়ম-দুর্নীতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও অনেক ক্ষেত্রে সঠিক সময় ব্যবস্থা নিতে পারছে না। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকে অন্যায় করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে একটি ভালো ব্যাংক কীভাবে নষ্ট হয়, বেসিক ব্যাংক তার বড় উদাহরণ। ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের দায়-দায়িত্ব কী হবে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু তা এখন আর সেভাবে মানা হচ্ছে না। ফলে ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে পরিচালকরা হস্তক্ষেপ করছেন। বাড়ছে খেলাপি ঋণ। তাই অনিয়মে জড়িয়ে পড়া ব্যাংকগুলোতে শুধু পর্যবেক্ষক দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। প্রতিবেদন দেখে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নিতে হবে।

পরিস্থিতি উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো কঠোর হতে হবে। অন্যথায় আগামীতে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে বলে মনে করেন সাবেক এ গভর্নর।

গেল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে রাষ্ট্রীয় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ ঋণের ২৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। একই বছরের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ৩৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা।

এছাড়া মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে বেসিক, সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি তিন হাজার ১৪০ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ঘাটতি এক হাজার ২৭৩ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৯০ কোটি টাকা। আর বিশেষায়িত বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি দুই হাজার ৫২৩ কোটি টাকা।

গত সেপ্টেম্বর শেষে পর্যবেক্ষক বসানো বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের তিন হাজার ২৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের খাতায় চলে গেছে। যা ব্যাংকটির বিতরণ ঋণের ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

এছাড়া আলোচিত সময়ে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭০৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৪৬ কোটি টাক, যা ব্যাংকটির বিতরণ ঋণের ২৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন হাজার ৬২৬ কোটি টাকা, বিতরণ ঋণের পাঁচ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক হাজার ৬০৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ ঋণের সাত দশমিক ৪৬ শতাংশ।

পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া চতুর্থ প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণ ঋণের সাত দশমিক ৪৫ শতাংশই খেলাপি। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ ২৩৮ কোটি টাকা। শীর্ষ ১০ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই ব্যাংকটির পাওনা ১৩৪ কোটি টাকা। আর এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৯৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

অন্যদিকে, দখল ও পর্ষদ পরিবর্তনে নিশ্চুপ থাকলেও সম্প্রতি অনিয়মে জড়িয়ে পড়া বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পর্ষদ পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও এনআরবিসির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসাত আলী।

এছাড়া অনিয়মের অভিযোগে অপসারণ হন এনআরবিসির এমডি দেওয়ান মুজিবুর রহমান ও ফারমার্স ব্যাংকের এমডি একেএম শামীম।

এসআই/এমএআর/পিআর

আমাদের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও হাত-পা বাঁধা, কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।