নিয়মের তোয়াক্কা করে না ফারমার্স ব্যাংক : চেয়ারম্যান-এমডিকে তলব

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৭:২৭ এএম, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে জড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া চতুর্থ প্রজম্মের ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড। পরিচালনা পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতায় অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করছে। ফলে বেড়েই চলছে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ও আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। এবার ব্যাংকটির অনিয়ম-দুর্নীতির কারণ দর্শাতে ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীমকে তলব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

জানা গেছে, ব্যাংকটি একদিকে উচ্চ সুদে আমানত গ্রহণ করছে। অন্যদিকে পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতায় যাচাই-বাছাই না করেই বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ বিতরণ করছে। এসব অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে জানা গেছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি যে পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়েছে এর প্রায় ৭৪ শতাংশই আদায়অযোগ্য। ফলে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ব্যাংকটি। জুন প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফারমার্স ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তিন মাসের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ, যার ৭৪ শতাংশই মন্দ ঋণ।

জুন শেষে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করেছে চার হাজার ৮২০ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৩০৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, যার ১৭৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা মন্দ ঋণ।

jagonews24রাজধানীতে ফারমার্স ব্যাংকের এটিএম বুথ উদ্বোধন করছেন চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন খান আলমগীর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ শ্রেণিকরণের (খেলাপি) তিনটি পর্যায় রয়েছে। তা হলো নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ বা ক্ষতি। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ নিম্নমানের ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ প্রভিশন, ৬ থেকে ৯মাসের মধ্যে হলে সন্দেহজনক ঋণ, যার বিপরীতে ৫০ শতাংশ প্রভিশন এবং ৯ মাসের বেশি হলে তা মন্দ বা ক্ষতি পর্যায়ে বিবেচিত হয়, এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আগস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফারমার্স ব্যাংক সবচেয়ে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। ব্যাংকটি গড়ে আট দশমিক ৭৮ শতাংশ হারে আমানতকারীদের সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছে। এর বিপরীতে ঋণ দিচ্ছে ১৩ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ হারে। এদিকে ব্যাংকটি আমানত হার ব্যাংকিং খাতের মোট আমানত হারের প্রায় দ্বিগুণ উঠেছে। আগস্টের ব্যাংকিং খাতে গড় আমানত দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশে।

নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ফারমার্স ব্যাংকে একাধিকবার বিশেষ পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আরও ১৯টি বিশেষ পরিদর্শন করে। এসব পরিদর্শনে ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ে। আর্থিক অনিয়ম ঠেকাতে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরপরও আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করেছে ফারমার্স ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী প্রচলিত ধারার কোনো ব্যাংক তার আমানতের ৮৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না। তবে এই নির্দেশনা উপেক্ষা করে ফারমার্স ব্যাংক ৯৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ করে। ফলে তা নিয়ন্ত্রণে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বার ব্যাংকটির অনিয়ম-দুর্নীতির কারণ দর্শাতে এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে তলব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ২৯ অক্টোবর (রোববার) সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২১তম বৈঠকে তাদের এসব অনিয়মের জবাব চাওয়া হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্দেশে গত ২৫ অক্টোবর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও এমডিকে বৈঠকে উপস্থিত থাকতে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ সব বিষয়ে ফারমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ কে এম শামীম জাগো নিউজকে বলেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আমাদের ডেকেছে। তবে এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে পারব না।

jagonews24জামালপুরে ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন করছেন চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন খান আলমগীর।

এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, শুধু একটি ব্যাংক নয়, বেশির ভাগ নতুন ব্যাংকের পরিচালন ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে তেমন যাচাই-বাছাই করা হয় না। এ ছাড়া ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে।

তাই নতুন ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন কার্যক্রমের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপশি যারা আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে জড়িয়ে পড়ছে তাদের নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ দেন সাবেক এ গভর্নর।

প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আগের মেয়াদে ২০১২ সালে চতুর্থ প্রজন্মের নয়টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়। অনুমোদন পাওয়া সব ব্যাংকই পান সরকার-সমর্থিত ব্যক্তিরা। এর মধ্যে অন্যতম ফারমার্স ব্যাংকের অনুমোদন পান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান মহিউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এসআই/জেডএ/আরআইপি

শুধু একটি ব্যাংক নয়, বেশির ভাগ নতুন ব্যাংকের পরিচালন ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে তেমন যাচাই-বাছাই করা হয় না। এছাড়া ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।