ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে চাল আনতে ব্যর্থ সরকার
অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে সরকার দৃষ্টি দেয় আন্তর্জাতিক বাজারে। সেখানেও বিভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত থেকে ‘সরকার থেকে সরকার’ (জি টু জি) পর্যায়ে চাল আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও ব্যর্থ হয় সরকার। একই পরিণতি হয় থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রেও। চাল মজুদ নিয়ে সঙ্কটের অন্যতম কারণ এটি বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্য নিয়ে ভিয়েতনামে গেলেও চুক্তি হয়েছে মাত্র আড়াই লাখ টনের। আর মিয়ানমারেও ১০ লাখ টন চাল কিনতে চেয়ে আশ্বাস পাওয়া গেছে তিন লাখ টনের। তবে মিয়ানমার থেকে চাল আনার পরিমাণ আরও বাড়ানোর জন্য রোববার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে জি টু জি পদ্ধতিতে ক্রয় কমিটি। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আজকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামীকাল আবার এ বিষয়ে বৈঠক হবে।
এদিকে সব মিলিয়ে ১৬ লাখ টন ধান, চাল ও গম সংগ্রহের যে ঘোষণা খাদ্যমন্ত্রী দিয়েছিলেন, তার ৭৮ শতাংশই অর্জিত হয়নি। ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও আমদানির মাধ্যমে ধান, চাল ও গম সংগ্রহ করা গেছে চার লাখ টনের কিছু বেশি। যদিও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযানের প্রাথমিক সময়সীমা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
এদিকে জি টু জি পদ্ধতিতে মিয়ানমার থেকে চাল আমদানির বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে ধানের বাম্পার ফলনে বাংলাদেশ চালের ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়। কিন্তু এ বছর আকস্মিকভাবে হাওর এলাকায় পাহাড়ি ঢলে বিপুল এলাকার বোরো জমি তলিয়ে যাওয়ায় এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও অকাল বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ব্লাস্টরোগ, পাহাড়ি ধস ও সাম্প্রতিক বন্যা প্রভৃতি কারণে চালের বাজার দরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে।
এসব বিবেচনায় নিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত চাল আমদানি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের পাশাপাশি সরকার থেকে সরকার (জি টু জি) পর্যায়ে চাল আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ইতোমধ্যে ভিয়েতনামের সঙ্গে আড়াই লাখ মেট্টিক টন চালের চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে এবং চালের সরবরাহ পাওয়া শুরু হয়েছে। ভারত ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে চাল আমদানির বিষয়ে যোগাযোগ ও আলোচনা হয়। কিন্তু ওই দুই দেশের সঙ্গে চালের দর নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় আলোচনা ব্যর্থ হয়।
অতঃপর কম্বোডিয়ার সঙ্গে আড়াই লাখ মেট্টিক টন চাল আমদানির আলোচনা সফল হয়েছে এবং চুক্তি স্বাক্ষরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এরমধ্যে চাল আমদানির বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় এবং মিয়ানমারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউনিয়ন মিনিস্টার জি টু জি পর্যায়ে চাল সরবরাহের আগ্রহ জানিয়ে গত ২৫ আগস্ট বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র প্রেরণ করেছেন। ওই পত্রে জি টু জি পর্যায়ে চাল সরবরাহ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য গত ৭ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
দেশের সরকারি মজুদ বৃদ্ধি করে সরকারি খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমদানির ক্ষেত্রে নানা উৎস থাকলে দ্রুত খাদ্যশস্য আমদানি সহজ হয়। এ বিবেচনায় মিয়ানমারের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সে দেশের সঙ্গে চাল আমদানির বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরসহ চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয় এবং খাদ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৫ সদস্যের প্রতিনিধিদল চাল আমদানি বিষয়ক দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য গত ৭ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার সফর করেন এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। কার্যপত্রে আরও বলা হয়, আজ ও আগামীকালের বৈঠকে চালের ধরন, পরিমাণ, শর্তাদি এবং দাম নির্ধারণ করা হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণভাবে আট লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী। ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পেরেছেন মাত্র আড়াই লাখ টন। সব মিলিয়ে ১৬ লাখ টন ধান, চাল ও গম সংগ্রহের যে ঘোষণা খাদ্যমন্ত্রী দিয়েছিলেন, তার ৭৮ শতাংশই অর্জিত হয়নি। ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও আমদানির মাধ্যমে ধান, চাল ও গম সংগ্রহ করা গেছে চার লাখ টনের কিছু বেশি। যদিও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযানের প্রাথমিক সময়সীমা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযানের ব্যর্থতার কথা নিজেও স্বীকার করেছেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তবে এজন্য তিনি দায়ী করেন বন্যা পরিস্থিতিকে। গত ১৬ আগস্ট সচিবালয়ে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এবার ১ কোটি ৯১ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, হাওর ও অন্যান্য এলাকার বন্যায় তা অর্জিত হচ্ছে না। সাত লাখ টন ধান ও আট লাখ টন চাল সংগ্রহের যে পরিকল্পনা করেছিলাম, সেটাও কিনতে পারিনি।
সংগ্রহ অভিযানের ব্যর্থতায় টান পড়েছে খাদ্য মজুদেও। সরকারের খাদ্যশস্যের মজুদ অস্বাভাবিক কমে এসেছে। ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাল ও গমের মজুদ ছিল ৪ লাখ ৫৪ হাজার টন, এক বছর আগে একই সময়ে সরকারের কাছে খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল যেখানে ১০ লাখ ৮৭ হাজার টন।
খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবেই কমছে খাদ্য মজুদ। জানুয়ারি শেষে ৯ লাখ ৪৩ হাজার টন খাদ্যশস্যের মজুদ থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ৯ লাখ ১০ হাজার টনে। মার্চে এ মজুদ আরও কমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৬৭ হাজার, এপ্রিলে ৫ লাখ ৬১ হাজার ও মে মাসে ৫ লাখ ৫৩ হাজার টনে। আর জুন শেষে সরকারের গুদামে খাদ্যশস্যের মজুদ নেমে আসে ৩ লাখ ৭৮ হাজার টনে।
উৎপাদন ও মজুদ কমায় চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হলে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়িয়ে তা সামাল দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। চাল আমদানির শুল্ক দুই দফায় কমিয়ে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এতে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি বাড়লেও এর প্রভাব পড়েনি বাজারে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা চালের রফতানি মূল্য বাড়িয়ে দেয়ায় শুল্ক কমানোর সুফল মিলছে না। বাজারে চালের দাম না কমে উল্টো বাড়ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৬ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
এসব বিষয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, সঙ্কট ও সমস্যার শুরুতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারাটা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বড় ভুল। তিনি বলেন, মজুদ শেষ হয়ে এলেও আমদানির পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বিলম্বে। এছাড়া উৎপাদনের বিষয়ে কাগুজে তথ্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সব বিষয় একত্রিত হয়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বলা যায়, পরিস্থিতি সামাল দিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ যখন চাল নিয়ে সঙ্কটে তখন ভারতসহ প্রতিবেশি দেশগুলো চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা প্রতিবেশি দেশ হয়েও এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক ভাবমূর্তি দেখিয়েছে। এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।
এমইউএইচ/ওআর/জেএইচ