উচ্চ আদালতে রউফ চৌধুরী ও সাঈদ চৌধুরীর শেয়ার কেলেঙ্কারি
শেয়ার কেলেঙ্কারি ঘটনায় র্যাংগস গ্রুপের কর্ণধার এম এ রউফ চৌধুরী এবং এইচআরসি গ্রুপের চেয়ারম্যান সাঈদ এইচ চৌধুরীর খালাসের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। হাইকোর্টে সম্প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ আপিল করেছে বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাসুদ রানা খান।
১৯৯৬ সালে প্রিমিয়ার সিকিউরিটিজের শেয়ার কেলেঙ্কারির অভিযোগে এম এ রউফ চৌধুরী এবং সাঈদ এইচ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। দীর্ঘ শুনানির পর গত ২৩ এপ্রিল শেয়ারবাজার সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক আকবর আলী শেখ এই দুই আসামিকে বেকসুর খালাস দেন।
এরপর হাইকোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে বিএসইসি। বিএসইসির আপিলের প্রেক্ষিতে গত ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট থেকে আপিল সংক্রান্ত একটি নির্দেশ আসে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। এক্ষেত্রে আসামিদেরকে অব্যাহতি ও জামিন নেয়ার কথা বলা হয়।
এর প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল আসামিদেরকে নোটিশ পাঠায়। ট্রাইব্যুনালের নোটিশের পর আসামি এম এ রউফ চৌধুরী ও সাঈদ এইচ চৌধুরী গত বুধবার স্ব-শরীরে হাজির হয়ে জামিন নেন। তাদের পক্ষে জামিন আবেদন করেন আইনজীবী পান্নু খান ও আব্দুস সালাম খান।
এদিকে প্রিমিয়ার সিকিউরিটিজের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় হওয়া মামলার নথি প্রেরণের জন্য ট্রাইব্যুনালকে নির্দেশও দেন হাইকোর্ট। এর প্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে নথি প্রেরণ করা হয়েছে বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাসুদ রানা খান।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রিমিয়ার সিকিউরিটিজ মামলায় রায়ের কপি পাওয়ার পরে বিএসইসি উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। এরপর উচ্চ আদালত থেকে মামলার নথি চাওয়া হয় এবং বিশেষ ট্রাইবুন্যাল থেকে মামলার নথি উচ্চ আদালতে পাঠানো হয়েছে। এখন উচ্চ আদালতেই এ মামলার বিচার কাজ চলবে।'
প্রিমিয়ার সিকিউরিটিজ শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলা সূত্রে জানা গেছে, মামলার আসামিরা প্রিমিয়ার সিকিউরিটিজের নামে ১৯৯৬ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করেছেন। ওই সময়ে তারা মিতা টেক্সটাইল, প্রাইম টেক্সটাইল, বাটা সুজ ও বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ার লেনদেন করেন। প্রতিষ্ঠানটি মোট ১২৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা লেনদেন করে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি শুধু ফরেন ডেলিভারি ভার্সেস পেমেন্টের (ডিভিপি) মাধ্যমে ৮৫ লাখ টাকা লেনদেন করে।
মামলার এক নম্বর আসামি প্রিমিয়ার সিকিউরিটিজ ওই সময়ে ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৩টি শেয়ার বিক্রি করে, যার মূল্য ছিল ৬৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। স্টক এক্সচেঞ্জের রেকর্ড মোতাবেক আসামিরা এসিআই লিমিটেডের ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮১৯টি শেয়ার বিক্রি করেন। অথচ ব্যাংক রেকর্ড অনুযায়ী শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫৩৮টি, যার মধ্যে ফরেন ডিভিপির মাধ্যমে লেনদেন অনিষ্পত্তি হওয়া শেয়ারের পরিমাণ ছিল ৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
একইভাবে আসামিরা ডিভিপির মাধ্যম ছাড়াও স্থানীয়ভাবে শেয়ারের অন্যতম ক্রেতা-বিক্রেতা ছিলেন। আসামিরা ওই সময়ের মধ্যে বেক্সিমকো ফার্মার ১৩ লাখ ২৪ হাজার ৭৯৫টি শেয়ার বিক্রি করেন। এর মধ্যে ডিভিপির মাধ্যমে ৯ লাখ ৯৮ হাজার ৭০০টি শেয়ার বিক্রি করেন। এখানেও অনিষ্পত্তি হওয়া শেয়ার ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৫০০টি। এ সব ফরেন ডিভিপির মাধ্যমে লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য প্রতিষ্ঠানটি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও ইন্দোসুয়েজ ব্যাংক ব্যবহার করত।
আসামিদের এ ধরনের কার্যকলাপ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির সম্মুখীন হন। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ-১৯৬৯ এর ২১ ধারা বলে গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।
প্রতিবেদনে আসামিরা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ-১৯৬৯ এর ১৭ ধারার ই (২) বিধান লঙ্ঘন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয় এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশের ২৪ ধারার অধীনে আসামিদের শাস্তি দেয়ার সুপারিশ করা হয়।
এ মামলার আসামিরা হলেন- প্রিমিয়ার সিকিউরিটিজসহ প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন চেয়ারম্যান এম এ রউফ চৌধুরী, পরিচালক সাঈদ এইচ চৌধুরী ও আনু জায়গীরদার এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান।
এদের মধ্যে রউফ চৌধুরী ও সাঈদ এইচ চৌধুরী শেয়ারবাজার সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল থেকে গত ২৩ এপ্রিল বেকসুর খালাস পান। ওই রায় দেয়ার সময় ট্রাইব্যুনালের বিচারক বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ১৯৬৯ অধ্যাদেশের ২৪ ধারায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামি এম এ রউফ চৌধুরী, সাঈদ এইচ চৌধুরী ও কোম্পানি প্রিমিয়ার সিকিউরিটিজকে এ মামলা থেকে বেকসুর খালাস দেয়া হচ্ছে।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ওইদিন সাঈদ এইচ চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত জীবনে কোনো কলঙ্ক ছিল না। আর ভবিষ্যতেও থাকবে না। তবে ১৯৯৬ সালে কিছু দুষ্টু লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়, যা পরে বুঝতে পারি। যে কারণে মামলায় জড়াতে হয়েছে। অথচ প্রিমিয়ার সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করে টাকাও ফেরত পাইনি। অন্যরা কোম্পানি বেনামে বিক্রয় করে টাকা আত্মসাৎ করে।
মামলার অপর দুই আসামি আনু জায়গীরদার এবং প্রিমিয়ার সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমানের বিচার কাজ হাইকোর্টের নির্দেশে বন্ধ ছিল। তবে চলতি বছরের ২ মে হাইকোর্টের ওই স্থগিতাদেশ শেষ হওয়ায় এখন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এই দুই জনের বিচারকাজ চলছে।
এই মামলায় মশিউর রহমান ও আনু জায়গীরদারের বিচারকাজে দুই দফায় ৬ মাস করে এক বছরের স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট। প্রথমবার ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল এ বিচারকাজে ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষে ২৯ নভেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দেন আদালত।
এমএএস/জেএইচ