ট্যানারি স্থানান্তর ও টাকার সঙ্কটে চামড়ার দরপতন
রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারির স্থানান্তর, নগদ অর্থের সঙ্কট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্মের কারণে কমেছে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম। একই সঙ্গে চামড়া পাচার হওয়ারও শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ট্যানারি মালিক, আড়তদার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। তারা জানান, এবার সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের কারণে অনেক কারখানা বন্ধ রয়েছে। চামড়ার চাহিদাও কম। অন্যদিকে স্থানান্তরের কারণে অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছেন ট্যানারি মালিকরা। প্রতি বছর কাঁচা চামড়া কিনতে নগদ টাকা দিলেও এবার কোনো অর্থ দেননি তারা। ফলে সরকার নির্ধারিত মূল্যেরও অর্ধেকে নেমে এসেছে চামড়ার দাম। ফলে বিপাকে পড়েছেন চামড়ার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
দেশে কাঁচা চামড়ার সবচেয়ে বড় আড়ৎ রাজধানীর লালবাগের পোস্তায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, এবার ১৪-১৬ বর্গফুটের প্রতি পিস ছোট আকারের গরুর চামড়ার দাম ৭০০ টাকা ৮০০ টাকা; ২০ থেকে ২২ বর্গফুটের মাঝারি আকারের চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১১শ’ টাকা এবং বড় আকারের ২৪-২৬ বর্গফুট চামড়ার দাম ১২শ’ থেকে ১৪শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ছাগলের চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়।
রাজধানীতে ৪০ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করছেন আনোয়ার হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এবারের মতো এত খরা কোনো সময় দেখিনি। গত বছরের এ সময় আট থেকে নয় হাজার পিস চামড়া কিনেছিলাম। এবার মাত্র সাড়ে চার হাজার পিস সংগ্রহ করেছি।
পোস্তার খুচরা চামড়া ক্রেতা আকবর আলী জানান, এবার পোস্তার মালিকরা চামড়ার দাম দিচ্ছেন না। গত বছর যে চামড়া বিক্রি করেছি ১৭ থেকে ১৮শ’ টাকায় এবার তা নেমে এসেছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। খাসির চামড়া ৬০ থেকে ৮০ টাকার বেশি দিচ্ছেন না। মাথার চামড়ার দাম গতবার যেখানে ৬০ থেকে ৭০ টাকা দেয়া হয়েছিল, এবার ২০ টাকাও দাম বলে না। ফেলে দিতে বলছেন অনেকে।
চামড়ার মৌসুমি ব্যবসায়ী আক্কাস জানান, গ্রিনরোড থেকে বড় গরুর চামড়া কিনেছি ১৪০০ টাকা দিয়ে। একশ টাকা রিকশা ভাড়া গেছে। পোস্তায় আনার পর সেই চামড়ার দাম উঠেছে ১১শ’ টাকা। নগদে চারশ টাকা লস।
‘বেঁধে দেয়া দামে চামড়া না কিনলে আগে থেকে এর মূল্য নির্ধারণের কোনো প্রয়োজন ছিল না’ বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
রামপুরা থেকে ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে আসা হোসেন মিয়া বলেন, সাতটি ছাগলের চামড়া এনেছি। দাম দিচ্ছে মাত্র ২২০ টাকা। চামড়া এখন কাগজ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিনস মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. টিপু সুলতান জাগো নিউজকে বলেন, স্থানান্তরের কাজ করায় বেশিরভাগ ট্যানারি বন্ধ রয়েছে। সাভারে ৭০টি গেলেও চালু রয়েছে মাত্র ৪০টি। এছাড়া বিদেশি বায়াররাও (ক্রেতা) আসছেন না। ফলে চামড়া কেনার আগ্রহ খুবই কম।
তিনি বলেন, প্রতি বছর ট্যানারির মালিকরা চামড়া কেনার জন্য নগদ অর্থ দিতেন। এবার এক টাকাও দেয়া হয়নি। প্রতি বছর কোরবানির আগে ট্যানারির মালিকরা আড়তদারদের পাওনা পরিশোধ করতেন। ওই টাকা দিয়ে কাঁচা চামড়া কেনা হতো। কিন্তু এবার কয়েকটি ছাড়া কেউ পূর্বের পাওনা পরিশোধ করেননি। ফলে টাকারও সঙ্কক দেখা দিয়েছে। এছাড়া এবার ঝুঁকিও রয়েছে। ফলে বেশি দামে কেউ চামড়া কেনার সাহস দেখাচ্ছেন না।
টিপু সুলতান বলেন, মাঝারি আকারের একটি চামড়ার দাম পড়ে ১২শ’ থেকে ১৩শ’ টাকা। কেনার পর লবণ দেয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি চামড়ার পেছনে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মতো খরচ হয়। ২০০ টাকা লাভ ধরলে প্রতি ফুটের দাম পড়ে ১৭ থেকে ১৮ টাকা। এই মূল্য না পেলে লস তো হবেই।
‘ট্যানারির মালিকরা পোস্তার ব্যবসায়ীদের গতবারের বকেয়া পরিশোধ না করে এবার সরাসরি মোসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কিনছেন’ বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাঁচা চামড়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। সঠিকভাবে লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করতে হবে। আগামী সপ্তাহ থেকে সারা দেশের চামড়া কেনা শুরু হবে। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি দাম দিয়েই কাঁচা চামড়া কেনা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ট্যানারি শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী কাঁচা চামড়ার ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশই আসে কোরবানির ঈদে। প্রতি বছর ১০ শতাংশ করে ধারাবাহিকভাবে পশু কোরবানি বাড়ে। কিন্তু এ বছর বাড়েনি। তাই এবারও ৫৫ লাখ গরুর চামড়াসহ ৭০ থেকে ৭৫ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ করা যাবে।
‘এ বছর চামড়ার পাচার বেশি হতে পারে’- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে শাহীন আহমেদ বলেন, প্রতি বছর ২০ শতাংশের মতো চামড়া পাচার হয়। সাভারে আমাদের স্থাপনাগুলো এখনও সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী কাঁচা চামড়া কিনতে ঋণ দেয়নি। তাই নগদ টাকার সঙ্কট থাকায় চামড়া কিনতে অগ্রীম অর্থ দেয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে পাইকার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সুবিধা মতো বিভিন্ন দরে চামড়া কিনছেন।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু নগদ টাকার সঙ্কটের কারণে অগ্রীম অর্থ দেয়া যায়নি সেহেতু এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাচারকারী চক্র নগদ অর্থ দিয়ে চামড়া কিনে সীমান্ত দিয়ে পাচার করতে পারে। এ জন্য আগামী এক মাস যাতে কোনো চামড়া পাচার না হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে আইন-শৃঙ্খলা ও সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীসমূহের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।’
শাহীন আহমেদ বলেন, গত বছর চামড়া কিনতে ব্যাংক থেকে সাড়ে ৪শ’ কোটি টাকা দেয়া হয়। কিন্তু এবার দেয়া হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে গত বছর ২০০ কোটি টাকা ঋণ দিলেও এ বছর তারা এক টাকাও দেয়নি।
প্রসঙ্গত, এবার সরকারিভাবে কোরবানির গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ঢাকায় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া সারাদেশে খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২০ থেকে ২২ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এসআই/এমএআর/এমএস