৪৪ বছরেও বাজেট গণমানুষের হতে পারেনি : ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ


প্রকাশিত: ০৩:৫৮ পিএম, ০৪ জুন ২০১৫

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু

জাগো নিউজ : এবার দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিশাল বাজেট। বাজেট নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে ১৬ কোটি মানুষ বসবাস করছে, এমন একটি দেশে ৩ লাখ কোটি টাকার বাজেট মোটেই বিশাল বলে মনে করি না। বাংলাদেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যয়ের সঙ্গতি ধরে কথা বললে, বাজেটের আকার আরো বড় হতে পারে।

জাগো নিউজ : অনেকেই তো বাজেটের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : হ্যাঁ, বাজেট নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বাজেট আলোচনায় কথা বলছে কারা? সরকারের নীতিনির্ধারকরা, আমলা বা আমাদের মতো আলোচক-সমালোচকরা? বলা যায়, নির্ধারিত ব্যক্তিরাই বাজেট নিয়ে আলোচনা করছে। সরকার আলোচনা করছে এফবিসিসিআই বা বিজিএমই-এর মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রামের একজন মুদি ব্যবসায়ীর প্রতিনিধিত্ব করে না। এফবিসিসিআই হাজার হাজার কোটি টাকার বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের কাছে একশ` টাকাই অনেক বড় কিছু।

জাগো নিউজ : তার মানে বাজেট পদ্ধতিতেই ত্রুটি আছে?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : হ্যাঁ, বাজেট অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিক। এখানে অঙ্কের যোগ-বিয়োগটাই অধিক গুরুত্ব পায়। এই খাতে এতো বাড়ানো হবে, আর এই খাতে এতো কমানো হবে, এটাই বাজেটের মূল আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। বাজেটে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বা তাদের প্রত্যাশার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। ৪৪ বছরেও বাজেট গণমানুষের হতে পারেনি। বাজেট আলোচনায় অনেক কিছুই বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে হয় না।

জাগো নিউজ : তার মানে প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়লেও গণমানুষের কাছে তা শুভঙ্করের ফাঁকি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : সরকারের বাজেট প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। কারো জীবনে ইতিবাচক আবার কারো জীবনে নেতিবাচক প্রভাবও পড়ে। এ কারণেই আমাদের মতো দেশে বাজেটকে অনেক ভাবনা চিন্তা করে প্রণয়ন করতে হয়। কিন্তু আমরা তা করি না। বাজেট হচ্ছে সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব।

বাজেটের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব, বেসরকারি উন্নয়ন এবং দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন। আমাদের দেশে প্রথম দুটি হয়, তৃতীয়টি আর হয় না। সরকারের বাজেট আলোচনায় বড় বড় রাস্তা, ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো বিষয় গুরুত্ব পায়। সেই ফ্লাইওভারে সাধারণ মানুষ কি সুবিধা পাচ্ছে, তারা সেই রাস্তায় আদৌ উঠতে পারছে কি না, তা গুরুত্ব পায় না। গরিব মানুষের সঙ্গে যা সরাসরি জড়িত সেখানে গুরুত্ব না দিলে উন্নয়ন কাঠামো দুর্বলই থেকে যায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্যে ব্যয় সাধারণ মানুষকে সরাসরি প্রভাবিত করে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নত হচ্ছে না, সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রামে শিক্ষা অবদান তেমন রাখছে না। স্বাস্থ্য প্রাইমারি লেভেলে ভালো করছে। কিন্তু সেকেন্ডারি লেভেলে ভালো নেই।

জাগো নিউজ : শিক্ষায়, স্বাস্থ্যসেবায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : শিক্ষা, স্বাস্থ্যে আপনি কাঠামোগত পরিবর্তন দেখছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে, হাসপাতালের ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এসব উন্নয়নের একটি মাত্র সূচক। একটি সূচক দিয়ে আপনি সব মূল্যায়ন করতে পারেন না। শিক্ষার মান নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুলছে। বাজেটে শিক্ষার ব্যয় যদি বেড়েই থাকে তাহলে মান বাড়ছে না কেন? আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন, কয়টি উপজেলা হাসপাতালে ভালো ডাক্তার আছেন? ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে, কমিউনিটি হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু কোনো সেবা নেই, ওষুধ নেই। একইভাবে শিক্ষার মান নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারছে। পাসের হার বাড়ছে কিন্তু মান ভয়াবহভাবে কমছে। প্রায়োগিক শিক্ষার ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই। সুতরাং বাজেটে যোগ-বিয়োগের পরিবর্তনকেই আপনি সত্যিকার উন্নয়ন বলতে পারেন না।

জাগো নিউজ : কার্যকর বাজেটের জন্য আপনার পরামর্শ কি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : আমি বলব, বাজেটের জন্য কার্যকর আলোচনা দরকার এবং সে আলোচনায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। লোক দেখানো আলোচনা কোনো কার্যকর পরিবর্তন আনতে পারে না। বাজেটের আগে আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়। আমি মনে করি, জানুয়ারি মাস থেকেই বাজেট নিয়ে কথা বলা উচিত। আলোচনা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে  হবে। এফবিসিসিআই, এনসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ’র মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের চাপে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। এসব প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সাধারণত গণমানুষের কথা সামান্যই থাকে। খাতা-কলমে বাজেট না দেখিয়ে প্রায়োগিক অর্থে বাজেট মূল্যায়ন করা দরকার। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বাড়ানোর জন্য আগে থেকেই ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আপনি জুন মাসে আলোচনা করে জুন মাসেই ঘোষণা করবেন, তাতে সব বিষয় আলোকপাত হয় না।

জাগো নিউজ : আঞ্চলিক বাজেটের কথা আসছে, এ নিয়ে আপনার অভিমত কি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : প্রশাসনিক ক্ষমতার বণ্টন না করে শুধু আঞ্চলিক বাজেট ঘোষণা করলেই হবে না। সবকিছুই তো কেন্দ্রীভূত। আপনি ঢাকায় বসে রংপুরের বাজেট করছেন। মনিটরিং নেই, সেখানকার সমস্যা চিহ্নিত করছেন না। ঢালাওভাবে জেলাভিত্তিক বাজেট করে দিলেন। এটি কোনো সুফল বয়ে আনবে না। জেলাভিত্তিক বাজেট ঘোষণা করার আগে প্রশাসনিক ক্ষমতার বণ্টন করতে হবে। একেক জেলার জন্য একেক সমস্যা। এই সমস্যা স্থানীয় সরকারই ভালো জানে। স্থানীয় সরকারের সত্যিকারভাবে ক্ষমতা বাড়ানো না হলে আঞ্চলিক বাজেট করে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে করি না।

জাগো নিউজ : এবারের বাজেটে রাজস্ব আয়কে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে মনে করছেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : গতবারের চেয়ে (২০১৪-১৫) রাজস্ব আয় সংশোধিত বাজেটের চেয়েও অনেক বেশি ধরা হয়েছে। আমি মনে করি, রাজস্ব আয় পূরণ করা খুব কঠিন হবে। ট্যাক্স বাড়াতে এবং দুর্নীতি কমাতে না পারলে এই রাজস্ব আয় হবে বলে মনে করি না। জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, দুর্নীতি রোধ করতে পারলেই রাজস্ব বাড়বে।

জাগো নিউজ : কালোটাকা সাদা করা বাজেটের অবধারিত (আইন করে) বিষয় হয়ে গেছে, এটি দুর্নীতিকে উসকে দিচ্ছে কি না?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : আমি কখনও কালোটাকা সাদা করার পক্ষে নই। কালো কালোই। কালোকে সাদা করা যায় না। কালো টাকা সাদা করার মধ্য দিয়ে সরকার অনৈতিক কাজে নৈতিক সমর্থন দিয়ে দিল। এটি রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতি আরো বাড়ে। যেমন, একজন ব্যক্তি কালোটাকা সাদা করার জন্য ৫ কোটি টাকার হিসাব দেখাল। ৫ কোটি টাকার হিসাব দেখানোর মধ্য দিয়ে সে ১০০ কোটি টাকার হিসাব গোপন রাখল। এসব দেখে একজন সৎ ব্যবসায়ীও অসৎ হতে চিন্তা করে।

এএসএস/আরএস/একে/আরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।