সরকারি কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার প্রক্রিয়া আবার পেছাল

মেসবাহুল হক
মেসবাহুল হক মেসবাহুল হক , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:০০ এএম, ২৭ জুলাই ২০১৭

সরকারি কোম্পানিগুলোর পুঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়ার প্রক্রিয়া আবারও পিছিয়েছে। দফায় দফায় বৈঠকের পর বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এ বিষয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। তবে সভায় কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সরকার।

বরং কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে করণীয় ঠিক করতে আবারো কমিটি গঠন হয়েছে। কমিটিকে আগামী জুনের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সভা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সভায় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণলয়ের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র সচিব ইউনুসুর রহমান, শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং কোম্পানিগুলোর অসহযোগিতার কারণে সরকারি কোম্পানিগুলোর পুঁজিবাজারে আসার সিদ্ধান্ত বার বার পেছাচ্ছে।অর্থমন্ত্রী একাধিকবার সময় বেধে দিয়েও কোম্পানিগুলোর পুঁজিবাজারে আনতে পারেনি। এটা দুঃখজনক।

তাদের মতে, বতর্মান বাজারে ভালো শেয়ার কম। ফলে দুর্বল শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে।

সূত্র জানায়, কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আনতে করণীয় ঠিক করতে অর্থ বিভাগরে অতিরিক্ত সচিব মো. মুসলিম চৌধুরীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কামিটি করা হয়েছে। কমিটিতে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। কমিটিকে চার মাসের মধ্যে কোম্পানিগুলোর সার্বিক পরিস্থিতির উপর প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি আগামী জুনে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে বলো হয়েছে। ওই প্রতিদন বিশ্লেষণ করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে সরকার।

সূত্র জানায়, শেয়ার ছাড়তে সরকারি কোম্পানিগুলো সভায় অনীহা প্রকাশ করেছে। ফলে ২০০৮ সাল থেকে সরকারি ২৬টি কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অর্থমন্ত্রী একাধিকবার সময় বেঁধে দিয়েছেন। তবে তিনি কোনোবারই কথা রাখতে পারেননি।

তার মতে, সরকারি কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হলে বাজার টেকসই হতো। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর অব্যবস্থাপনা অনেকাংশে কমে যাতো। বেড়ে যেত কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারের স্বার্থে ও স্বচ্ছতা বাড়ানোর লক্ষ্যেই সরকারি কোম্পানিগুলোকে দ্রুত তালিকাভুক্ত করা উচিত। কারণ ভালো শেয়ার এলে নতুন বিনিয়োগকারী আসবে। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ভালো মিউচুয়াল ফান্ড আসবে। ফলে বাজারের গভীরতাও বাড়বে।

মির্জ্জা আজিজ বলেন, বাজারে মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। এটি কাটাতে ভালো শেয়ার থাকা জরুরি।

বৈঠকের কার্যবিবরণীতে দেখা গেছে, সরকারি ২৬ কোম্পানির মধ্যে শেয়ার ছাড়ার জন্য তালিকায় ৯টি কোম্পানি রয়েছে।এর সবগুলোই জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের। তবে তারা এ মুহূর্তে পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী নয়। কোম্পানিগুলোকে নিয়ে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সভা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। তখন শেয়ার ছাড়ার বিষয়ে তাদের মতামত দেয়ার সময় বেঁধে দেয়া হয়। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়তে (অফলোড করতে) পারেনি।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাখরাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি জানিয়েছে, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মাধ্যমে কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউশন মার্জিন হ্রাস করায় আয় অনেক কমেছে। চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় সিএনজি, বাণিজ্যিক এবং আবাসিক সংযোগ বন্ধ রয়েছে। পরিচালনা বা কোম্পানির যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থের সংস্থান করা সম্ভব নয়। তবে গ্যাসের নতুন রিজার্ভ আবিষ্কার ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে শেয়ার অফলোডের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানিকে ২০০৮ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনবার সময় দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ সময় ছিল ২০১০ সাল। কিন্ত ২০১৭ সালে কোম্পানিটি জানিয়েছে, চলমান প্রকল্পসমূহের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিজস্ব তহবিল, পেট্রোবাংলার অধীনস্থ কোম্পানিগুলো থেকে গৃহীত ঋণ ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের নিশ্চয়তা থাকায় পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন নেই।

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি বন্ড ইস্যুর অগ্রগতি সম্পর্কে জানিয়েছে, উচ্চ সুদে বন্ডের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে এ ধরনের ব্যয়বহুল অনিশ্চয়তামূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হলে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ক্রমশ আরও দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ জন্য গ্যাসের নতুন রিজার্ভ আবিষ্কার ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে ভবিষ্যতে বন্ড ইস্যুর বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পরে।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের তালিকায় থাকা অন্য কোম্পানিগুলো হচ্ছে- লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস লিমিটেড (এলপিজিএল), জালালাবাদ গ্যাস টিঅ্যান্ডটি সিস্টেম লিমিটেড, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড।

বিদ্যুৎ বিভাগের পাঁচটি কোম্পানিও শেয়ার অফলোডের বিষয়ে ইতিবাচক কোনো মতামত দেয়নি। এর মধ্যে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি শেয়ার অফলোডের বিষয়ে কোনো তথ্য-উপাত্তই দেয়নি। একই অবস্থা ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড ও আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের।

তবে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কোম্পানির আরও ১৫ শতাংশ সরকারি শেয়ার পুঁজিবাজারে অফলোডের সুপারিশ পাঠানোর জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বিএসইসি এবং আইসিবির সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি কোম্পানি শেয়ার অফলোডের বিষয়ে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কোম্পানিগুলো হলো- প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ, চিটাগাং ড্রাইডক, কর্ণফুলী পেপার মিলস, বাংলাদেশ ইন্স্যুলেটর অ্যান্ড সেনিটারি ওয়্যার ফ্যাক্টরি ও ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লিমিটেড।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তিনটি কোম্পানি মধ্যে শেরাটন হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে হোটেলের রিনোভেশনের কাজ চলছে যা ২০১৮ সালের প্রথমার্ধে শেষ হবে। কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর রি-ব্র্যান্ডিং করে শেয়ার অফলোডের ব্যবস্থা করা হবে।

সোনারগাঁও হোটেল জানিয়েছে, বর্তমানে সংস্থার সংস্কার ও সম্প্রসাণের কার্যক্রম চলছে, যার আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। এটি সম্পন্ন হওয়ার পর শেয়ার অফলোডের উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব হবে।

এ ছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স জানিয়েছে, সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী শেয়ার অফলোডর জন্য পর পর তিন বছর লাভ থাকার বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে বিমান ২৭২ কোটি ২২ লাখ টাকা মুনাফা করেছে। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরেও মুনাফা হয়েছে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে লাভজনক অবস্থায় থাকলে শেয়ার অফলোডের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের আওতাধীন চারটি কোম্পানির মধ্যে টেলিটক জানিয়েছে, ইতিমধ্যে আইসিবির সঙ্গে সভা হয়েছে। আইসিবির পরামর্শ ও মতামত অনুযায়ী কোম্পানিকে লাভজনক করার পরিকল্পনা চলমান রয়েছে।

বিটিসিএল জানিয়েছে, শেয়ার অফলোডের লক্ষ্যে বিটিসিএলের গত চার বছরের ব্যালেন্সশিট আইসিবি পর্যবেক্ষণ করছে। আইসিবির মতামত ইতিবাচক হলে শেয়ার অফলোডের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেড জানিয়েছে, মূলধনে ঘাটতি না থাকায় পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন হচ্ছে না।

একইভাবে টেলিফোন শিল্প সংস্থা জানিয়েছে, তাদের আর্থিক অবস্থা শেয়ার অফলোডের উপযোগী নয়।

স্বাস্থ্য বিভাগের আওতাধীন অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগস জানিয়েছে, কোম্পানির পর্ষদ পুঁজিবাজারে শেয়ার অফলোড সংক্রান্ত কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রেখেছে।

এমইউএইচ/এএইচ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।