ব্যাংকে টাকা রাখলে কি লোকসান?


প্রকাশিত: ০৪:৩৫ পিএম, ০৩ জুন ২০১৭

নতুন অর্থবছরের (২০১৭-১৮) প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক হিসাবের ওপর আবগারি শুল্ক পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে কোনো গ্রাহকের ব্যাংকে বছরে এক লাখ টাকা বা তার নিচে থাকলে আবগারি শুল্ক দিতে হবে না। তবে এক লাখ টাকার বেশি অর্থাৎ এক লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত থাকলে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হবে। বর্তমানে এই আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে এই আবগারি শুল্ক বাড়ানোর কারণে ব্যাংকের সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে ধারণা করছেন ব্যাংক হিসাবে বছরে এক লাখ টাকার ওপরে রাখলে বছর শেষে মুনাফা তো দূরের কথা আসল টাকাও ফেরত পাবেন না।

এ ধারণাটি আসলেই কি সঠিক? একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি মিলিয়ে নেয়া যাক। একজন গ্রাহক তার ব্যাংক হিসাবে এক বছর ধরে ১০ লাখ টাকা জমা করে রাখলেন। এখন আমানতের সুদ হার ৫ শতাংশ (বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদ হার ৫ দশমিক ১ শতাংশ) ধরা হলেও বছর শেষে তিনি জমা করা টাকার ওপর মুনাফা পাবেন ৫০ হাজার টাকা। টিআইএন নম্বর না থাকলে এ মুনাফার ওপর থেকে কর কাটা হবে ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ৭ হাজার ৫০০ টাকা (টিআইএন নম্বর থাকলে কাটা হবে ১০ শতাংশ বা ৫ হাজার টাকা)। সেই সঙ্গে ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ হিসাবে কাটা হবে আরও ৫০০ টাকা।

সুতরাং টিআইএন নেই এমন গ্রাহক হলে ১০ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রাখলে বছর শেষে মুনাফা পাবেন ৪২ হাজার টাকা (৫০০০০-৭৫০০-৫০০)। এই মুনাফা থেকে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক কেটে রাখা হলে বছর শেষে তিনি মুনাফা পাবেন ৪১ হাজার ২০০ টাকা। অর্থাৎ ১০ লাখ টাকা ব্যাংকে এক বছর ধরে জমা রাখলে লোকসান তো হবেই না বরং ৪১ হাজার ২০০ টাকা মুনাফা পাওয়া যাবে।

এখন ধরা যাক, একজন গ্রাহকের ব্যাংকে আছে এক লাখ ১০ হাজার টাকা। আমানতের সুদ হার ৫ শতাংশ ধরা হলেও বছর শেষে তিনি জমা টাকার ওপর মুনাফা পাবেন ৫ হাজার ৫০০ টাকা। টিআইএন নম্বর না থাকলে এ মুনাফার ওপর থেকে ১৫ শতাংশ বা ৮২৫ টাকা কর বাবদ কেটে রাখা হবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ হিসাবে কাটা হবে ৫০০ টাকা।

সুতরাং টিআইএন নম্বর নেই এমন গ্রাহক হলে এক লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা রাখলে বছর শেষে মুনাফা পাবেন ৪ হাজার ১৭৫ টাকা (৫৫০০-৮২৫-৫০০)। এই মুনাফা থেকে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক কেটে রাখা হলে বছর শেষে তিনি মুনাফা পাবেন ৩ হাজার ৩৭৫ টাকা। এ ক্ষেত্রেও গ্রাহককে লোকসান গুনতে হবে না বরং বছর শেষে তিনি ৩ হাজার ৩৭৫ টাকা মুনাফা পাবেন। অবশ্য আবগারি শুল্ক আগের হার বহাল থাকলে আরও ৩০০ টাকা বেশি মুনাফা পাওয়া যেত।

আবগারি শুল্ক চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাব থেকে কাটা হয় বছরে একবারই। গ্রাহকের প্রতি লেনদেনের ওপর আবগারি শুল্ক কাটা হয় না। আর এই শুল্ক সাধারণত কেটে নেয়া হয় বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকে টাকা রাখলে লোকসান নয় কিছুটা মুনাফাই পাচ্ছেন গ্রাহক। তবে মূল্যস্ফীতির হার ধরে হিসাব করলে ব্যাংকে টাকা রেখে লোকসান গুনতে হচ্ছে গ্রাহককে। যদি মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়, তাহলে এক লাখ ১০ হাজার টাকায় বছর শেষে মুনাফা ৬ হাজার ৫০ টাকা পেলেই লোকসান হবে না। এর কম পেলেই লোকসান। সে হিসাবে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক বসানো হলে গ্রাহককে লোকসান গুনতে হবে ২ হাজার ৬৭৫ টাকা (৬০৫০–৩৩৭৫)।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আবগারি শুল্ক বাড়ানোর কারণেই কি গ্রাহককে লোকসান গুনতে হচ্ছে? বর্তমানে আবগারি শুল্কের যে হার তাতেও গ্রাহককে লোকসান গুনতে হচ্ছে। কারণ আবগারি শুল্ক ৮০০ টাকার বদলে ৫০০ টাকা হলে এক লাখ ১০ হাজার টাকা এক বছর ধরে ব্যাংকে রেখে মুনাফা হিসেবে পাওয়া যাবে ৩ হাজার ৬৭৫ টাকা টাকা। অর্থাৎ বর্তমান বহাল থাকা আবগারি শুল্ক হারে গ্রাহককে লোকসান গুনতে হচ্ছে ২ হাজার ৩৭৫ টাকা। মূলত মূল্যস্ফীতি ও আমানতের কম সুদ হারের কারণে গ্রাহককে এ লোকসান গুনতে হচ্ছে। যদি আমানতের সুদ হার বেশি হতো তাহলে গ্রাহককে লোকসান গুনতে হতো না।

যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এখন যে অবস্থায় এসেছে ফিক্সড ডিপোজিটে (স্থায়ী আমনাত) টাকা রাখলে ৫-৬ শতাংশ ইন্টারেস্ট (সুদ) পাওয়া যাবে। মূল্যস্ফীতিও তার সমপর্যায়ে। কোন কোন ক্ষেত্রে সুদ হারের থেকে মূল্যস্ফীতি বেশি। তার মানে ব্যাংকে টাকা রাখলে নেগেটিভ রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হলে নেগেটিভের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।

পাঁচ শতাংশ সুদ হার ধরে ব্যাংকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা এক বছর ধরে রাখলে সব চার্জ বাদ দিয়ে মুনাফা পাওয়া যাবে ৩ হাজার ৩৭৫ টাকা, তাহলে ব্যাংকে টাকা রেখে আসল টাকাও ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না এ যুক্তিটি কোন দিক থেকে সঠিক? এমন প্রশ্ন করলে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, মূল্যস্ফীতিকে বাদ দিয়ে দেখালে দেখা যাবে ৩ হাজার ৩৭৫ টাকা মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি হিসাবে ধরলে লোকসান গুনতে হচ্ছে। কারণ ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ধরলে এক লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যাংকে রেখে মূলত বছর শেষে পাওয়া যাচ্ছে ১ লাখ ৭ হাজার ৮৭৫ টাকা {১১০০০০-(৫৫০০-৩৩৭৫)}। সুতরাং গ্রাহককে তো লোকসানই গুনতে হচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আবগারি শুল্ক বাড়ানোর কারণে গ্রাহকের মুনাফা কিছুটা কম আসবে, লোকসান হবে না। তবে সুদের হার যদি এক শতাংশের নিচে হতো তাহলে গ্রাহকের লোকসান হতো।

মূল্যস্ফীতি হিসাবে ধরলে গ্রাহকরা কি মুনাফা পাবেন? এমন প্রশ্ন করা হলে এই বিশ্লেষক বলেন, মূল্যস্ফীতিকে যদি হিসাবে ধরা হয় তাহলে এখনও গ্রাহকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। কারণ মূল্যস্ফীতি যদি ৫ শতাংশও ধরা হয় তাহলে এক লাখ টাকায় বছরে ৫ হাজার টাকা পেলে লোকসান হবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো বর্তমানে আমানতের যে সুদ হার তাতে এক লাখ টাকায় বছরে ৫ হাজার টাকা মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে না। সে হিসাবে গ্রাহকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। সুতরাং আবগারি শুল্ক না বাড়ালেও গ্রাহকদের লোকসান গুনতে হবে।

এমএএস/জেএইচ/ওআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।