ভ্যাট নির্ধারণে অর্থ বিভাগ ও এনবিআরের সঙ্গে বসছেন প্রধানমন্ত্রী


প্রকাশিত: ০৩:৩৯ পিএম, ০৮ মে ২০১৭

আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এ আইন অনুযায়ী সব ক্ষেত্রেই ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) আরোপ করা হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাটের এ হার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। আর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়াবে।

ভ্যাটের হার নির্ধারণ বাস্তবসম্মত করতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১১ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এবং ১৪ মে ভ্যাট আহরণকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ভ্যাটের হার নির্ধারণে আগামী ১১ মে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। তিনি বলেন, নতু্ন আইন অনুযায়ী সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করতে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে জনগণের কষ্টের কথা মাথায় রেখে যদি এ হার কিছুটা কমানো হয় তাহলেও তা ১২ শতাংশ কমের সুযোগ নেই। কারণ বাজেট বাস্তবায়নে ব্যয়ের সঙ্গে আয় বাড়াতে হবে।

ভ্যাটের হার খুব বেশি কমানো হলে রাজস্ব আয় কমে যাবে। ফলে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বলেও মত দেন তিনি।

এদিকে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট রেখে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের পক্ষে মতামত দেবেন। এনবিআরের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নতুন মূসক আইন হলে ট্যারিফ লাইনের ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপিত হবে। এখন যেসব পণ্য বা সেবার ওপর দেড় থেকে ১০ শতাংশ হারে মূসক আছে, তাতেও ১৫ শতাংশ মূসক বসবে।

বর্তমানে ট্যারিফ লাইনে ছয় হাজার ৪৭৩ ধরনের পণ্য আছে। সেই হিসাবে চার হাজার ৮১৬ ধরনের পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূসক বসবে। বর্তমানে এক হাজার ৯৮৩টি পণ্য ও সেবায় মূসক দিতে হয় না।

তবে নতুন আইনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় থাকছে। যেমন- মৌলিক খাদ্য, নির্ধারিত জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহনসেবা, গণস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কৃষি, মৎস্য চাষ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অবাণিজ্যিক কার্যক্রম, অলাভজনক সাংস্কৃতিক সেবা— এসব ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বাকি সব ক্ষেত্রেই আমদানি বা উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি পর্যায়ে মূসক বসবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের  সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইন যদি ১ জুলাই থেকেই বাস্তবায়িত হয় এবং ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশই থাকে তাহলে পণ্যের দাম শুরুতেই বেড়ে যাবে, যা ভোক্তাদের বেশ ভোগাবে।

তিনি বলেন, মূসকের জন্য বাড়তি অর্থ দিতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি হবে। অবশ্য পরে বাড়তি মূল্যেই পণ্যের দাম ঠিক হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, রেয়াতি হারে মূসক রাখার পক্ষে আমি নই। মূসক সব ক্ষেত্রেই একই হারে হতে হবে। তবে ১৫ শতাংশ মূসক একটু বেশি। এটা ১০ শতাংশ করা উচিত।

নতুন ভ্যাট আইন প্রসঙ্গে ড. মামুন রশীদ বলেন, ‘উচ্চ আয়কর হারের সঙ্গে করপোরেট কর ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হলে ব্যবসার খরচ অনেক বাড়বে। এত বেশি আয়কর ও করপোরেট কর আর কোনো দেশে নেই। ভ্যাট আইন নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, তা অসংগত নয়। আশা করি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় ভ্যাটের হারে পরিবর্তন আসবে।’

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মূসক হার সাড়ে ১২ শতাংশ। তবে কিছু রাজ্যে নির্দিষ্ট কিছু পণ্য বা সেবায় ১৫ শতাংশ গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (জিএসটি) দিতে হয়। জিএসটি আরোপের ক্ষমতা ওই রাজ্য সরকারের।

১৩ শতাংশ মূসক দেন নেপালের নাগরিকরা। অন্যদিকে আফগানিস্তানে মূসক হার একাধিক। ওই দেশের পণ্য ও সেবাভেদে ২ থেকে ১০ শতাংশ মূসক দিতে হয়। পাকিস্তানে ১৭ শতাংশ হলেও বিদ্যুৎ বিল, চিনি, ট্রাক্টর, ক্রীড়াসামগ্রী, চামড়া, বস্ত্রসহ বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় রেয়াতি হারে মূসক আরোপ হয়। যেমন ২০ হাজার রুপির কম বিদ্যুৎ বিল হলে ৫ শতাংশ হারে মূসক বসে। একই অবস্থা শ্রীলঙ্কায়। সেখানে ১৫ শতাংশ মূসক আরোপ হলেও কিছু ক্ষেত্রে শূন্য হার প্রযোজ্য।

মালদ্বীপ ও ভুটানে মূসক না থাকলেও গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (জিএসটি) আছে। মালদ্বীপে সব ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ এবং পর্যটন খাতে ১২ শতাংশ জিএসটি আরোপ হয়। ভুটানে খুব সীমিত পরিসরে ৫০ শতাংশ জিএসটি আরোপ হয়।

ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমারে ১০ শতাংশ হারে মূসক বসে। সারা বিশ্বের দেড়শর বেশি দেশে মূসক ও জিএসটি আছে। ৫৮টি দেশে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হারে মূসক দিতে হয়। তবে ওই সব দেশের বেশির ভাগই উন্নত দেশ; যেখানে আধুনিক ও উন্নত হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনেই নতুন এ মূসক আইন তৈরি করা হয়। ২০০০ সালের পর থেকে সংস্থাটি ১৯৯১ সালের মূসক আইন সংস্কারের তাগিদ দিয়ে আসছিল। ২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আইএমএফের একটি মিশন ঢাকায় আসে। তবে সে সময় আইএমএফের সুপারিশ আমলে নেয়া হয়নি।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর আইএমএফ নতুন মূসক আইন করার বিষয়ে আবারও তাগিদ দেয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশকে বর্ধিত ঋণ সহায়তার (ইসিএফ) প্রায় ১০০ কোটি ডলার অনুমোদন করে আইএমএফ। এ ঋণ পাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল নতুন মূসক আইন করা। এ ঋণের প্রথম কিস্তির আগেই নতুন আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয়।

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় মূসক আইন তৈরি করা হয়। দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়ার আগে জাতীয় সংসদে আইন পাস হয়। আইনটি বাস্তবায়নে সার্বিক প্রস্তুতির জন্য ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময় পায় এনবিআর। পরে অবশ্য আরও এক বছর বাড়ানো হয়। ফলে চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে এ আইনের বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে।

এমইউএইচ/এমএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।