আতঙ্ক বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের


প্রকাশিত: ০৬:৩৩ এএম, ২৭ এপ্রিল ২০১৭

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে অধিকাংশ ব্যাংক ভালো মুনাফা করতে পারেনি- এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে পুঁজিবাজারে। যার প্রভাবে টানা দরপতন ও লেনদেন খরা দেখা দিয়েছে।

টানা দরপতন দেখা দেয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। দরপতন আরও দীর্ঘ হতে পারে- এমন শঙ্কায় বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে পুঁজিবাজার। মূলত একটি চক্র ফায়দা লুটতে পরিকল্পিতভাবে বাজারে গুজব ছড়াচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের উচিত কোনো প্রকার গুজবে কান না দিয়ে সার্বিক তথ্য ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া।

তাদের পরামর্শ, বর্তমান পরিস্থিতিতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করা বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে না। বরং মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার বাছাই করে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

মূলত গত ২৩ মার্চ থেকে দরপতনের মধ্যে রয়েছে পুঁজিবাজার। টানা বাড়তে থাকা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ওইদিন পড়ে যায় ১০ পয়েন্ট এবং লেনদেন কমে যায় ২৫০ কোটি টাকার ওপর।

ওই পতনের পর ছোট ছোট উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে পুঁজিবাজারের লেনদেন। তবে গত ৫ এপ্রিল থেকে টানা পতনের বৃত্তে রয়েছে বাজার। ৫ থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩ কার্যদিবসের মধ্যে ১২ দিনই দরপতন হয়েছে। এ সময়ে ডিএসইএক্স কমেছে ৩৩৯ পয়েন্ট।

টানা এ দরপতনের প্রথমদিকে পুঁজিবাজারে গুঞ্জন ছিল ইসলামী ব্যাংকের মতো বড় প্রতিষ্ঠান কম লভ্যাংশ ঘোষণা করায় অন্য ব্যাংকগুলোও আশানুরূপ লভ্যাংশ দেবে না। এর সঙ্গে সম্প্রতি বাজারে গুঞ্জন ছড়ায় শেষ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো ভালো মুনাফা করতে পারেনি। এমন গুঞ্জনের কারণে গত কয়েকদিন ধরে অধিকাংশ ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমছে।

বিনিয়োগকারী মো. মনির হোসেন বলেন, গত দেড় বছর ধরে বাজার অনেকটাই স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে বাজার অস্বাভাবিক আচারণ করছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বাজার টানা বেড়েছে। এখন আবার টানা দরপতন হচ্ছে। এখন শুনছি, ব্যাংকিং খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো মুনাফা করতে পারেনি। এটা হয়তো পুঁজিবাজারের জন্য খারাপ সংবাদ।

বিনিয়োগকারী আরিফুল ইসলাম বলেন, গত ১৬ এপ্রিল একটি ব্যাংকের শেয়ার ২৩ টাকা দরে কিনেছিলাম। এখন সেই শেয়ারের দাম ১৯ টাকায় চলে এসেছে। প্রতিদিনই ব্যাংকটির শেয়ারের দাম কমছে। এভাবে দাম কমলে বাজারের ওপর আস্থা থাকে কীভাবে?

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের শেষ কার্যদিবসে ডিএসই’র প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৩৬ পয়েন্টে। অনেকটা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে সেই সূচক মার্চ শেষে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭১৯ পয়েন্টে। অর্থাৎ তিন মাসে ডিএসইএক্স বাড়ে প্রায় ৬৮৩ পয়েন্ট। আর গত ১৩ কার্যদিবসে ডিএসইএক্স কমেছে ৩৩৯ পয়েন্ট।

মূল্য সূচকের পাশাপাশি গত কয়েকদিনে লেনদেন ও বাজার মূলধনেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা পড়েছে। একের পর এক রেকর্ড সৃষ্টি করা বাজার মূলধন ও লেনদেন এখন অনেকটাই তলানিতে। টানা ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে গত ৪ এপ্রিল নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যায় ডিএসইর বাজার মূলধন। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ওইদিন ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকায়। গত কয়েকদিনের টানা পতনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা।

টানা তিন মাস গড়ে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন বর্তমানে নেমে এসেছে ৫০০ কোটি টাকার ঘরে। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারির ২৩ কার্যদিবসের মধ্যে ২১ কার্যদিবসই এক হাজার কোটি টাকার ওপর লেনদেন হয়। আর প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয় প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি ও মার্চজুড়ে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয় এক হাজার কোটি টাকার ওপরে। সেখানে চলতি মাসের ১৬ কার্যদিবসে মাত্র দু’দিন হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বাজারে যে দারপতন দেখা দিয়েছে তা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বর্তমানে আমানত ও সঞ্চয়পত্রে যে সুদের হার তাতে স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাজারে টাকা আসার কথা। এ মুহূর্তে টানা দরপতন কিছুতেই কাম্য নয়।

ব্যাংকের বিষয়ে তিনি বলেন, যে ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে তার মধ্যে দু-একটি বাদে সবাই ভালো লভ্যাংশ দিয়েছে। এটি ভালো লক্ষণ। তবে খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংকের কিছু সমস্যা আছে। এছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলোতে কিছু সমস্যা আছে। তবে রূপালী ব্যাংক ছাড়া সরকারি অন্য কোনো ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়। সে হিসাবে ব্যাংকের কারণে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে- এমন ধারাণা ঠিক নয়।

‘আমার ধারণা বিনিয়োগকারীরা সঠিক আচরণ করছেন না। বিনিয়োগকারীদের উচিত যখন দাম কমে তখন শেয়ার কেনা এবং ঊর্ধ্বমুখী বাজারে শেয়ার বিক্রি করা। সেখানে ঊর্ধ্বমুখী বাজারে শেয়ার কেনা এবং নিম্নমুখী বাজারে বিক্রি করা যুক্তিসঙ্গত আচরণ হতে পারে না। বিনিয়োগকারীদের উচিত গুজবে কান না দিয়ে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন শেয়ারে বিনিয়োগ করা। ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে ব্যাংকে আমানত রাখার থেকে বেশি মুনাফা পাওয়া সম্ভব’- বলেন এ অর্থনীতিবিদ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, দাম কমে যাওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ এখন মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনছেন। তাদের কাছে থাকা অন্য কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন। যার একটি নেতিবাচক প্রভাব সার্বিক খাতেই পড়ছে। তবে যাদের কাছে মৌলভিত্তিসম্পন্ন শেয়ার আছে, তাদের লোকসানের সম্ভাবনা নেই।

তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগকারীদের উচিত হুজুগে বা গুজবে অতিলোভের আশায় দুর্বল কোম্পানির শেয়ার না কেনা। অল্পদিনেই অধিক মুনাফার লোভ থাকলে লোকসানের শঙ্কা থাকবেই। কিন্তু ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনে তা ধরে রাখলে আগামী দুই বছরেও লোকসান গুনতে হবে না।

এমএএস/এমএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।