হাজারীবাগে ট্যানারি অধ্যায়ের সমাপ্তি
আদালতের নির্দেশে রাজধানীর হাজারীবাগে থাকা ট্যানারিগুলোর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছে পরিবেশ অধিদফতর। রোববার দুপুরের আগেই সংযোগ বিচ্ছিন্নের সব কাজ শেষ হবে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের ফলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ট্যানারিগুলোর উৎপাদন। এর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটছে হাজারীবাগের ট্যানারি অধ্যায়ের।
বাংলাদেশ স্বাধীনের আগেই ১৯৫০ সালে হাজারীবাগে শুরু হয় ট্যানারির কার্যক্রম। সেই সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করা ২১টি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে ট্যানারির কার্যক্রম শুরু করে। এরও আগে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাংলাদেশে ট্যানারি কারখানার সূত্রপাত ঘটে।
নারায়ণগঞ্জে ‘ঢাকা ট্যানারি’ নামের ওই কারখানাটি গড়ে তোলেন আর বি সাহ নামের এক ব্যবসায়ী। দানবীর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আর বি সাহ’র হাত ধরে গড়ে ওঠা ঢাকা ট্যানারির অস্তিত্ব এখনও আছে। তবে এর মালিকা বদলি হয়েছে কয়কে দফা। নারায়ণগঞ্জে ঢাকা ট্যানারির কার্যক্রম চলে প্রায় তিন বছর।
ঢাকা ট্যানারির পাশাপাশি হাজারীবাগে ট্যানারি কার্যক্রম শুরু করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল- ইস্ট পাকিস্তান ক্রোম ট্যানারি বা ঢাকা হাইডেন, দিলকুশা ট্যানারি, ইস্ট বেঙ্গল ট্যানারি, পাকিস্তান ট্যানারি, এসএনএ ট্যানারি, ইউনাইটেড ট্যানারি, হাফিজ ট্যানারি, রহমানিয়া ট্যানারি, ন্যাশনাল ট্যানারি, বেঙ্গল ন্যাশনাল ট্যানারি, মাহতাব ট্যানারি, নর্থ ইস্ট ট্যানারি, ফেরদৌস ট্যানারি, বেঙ্গল কর্পোরেশন, ওরিয়ন ট্যানারি, রাজ্জাক ট্যানারি, পাইওনিয়র ট্যানারি, মাহতাব-২ ও ওমর ট্যানার। এর সবকটির মালিকানা ছিল পাকিস্তানিদের দখলে।
বাঙালি মালিকানায় থাকা ঢাকা ট্যানারি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করা পাকিস্তানিদের ২১টিসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান দিয়ে হাজারীবাগে শুরু হওয়া ট্যানারিশিল্প ধীরে ধীরে জমজমাট হয়ে উঠে। ১৯৬৬ সালের দিকে ট্যানারির সংখ্যা বেড়ে ২০০ ছাড়িয়ে যায়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান সরকারের অধিগ্রহণ করা ২১টি ট্যানারি বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয়া হয়।
১৯৭৬ সালের পর ছোট ছোট কিছু ট্যানারি গড়ে উঠলেও বড় কোনো ট্যনারি গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে হাজারীবাগে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩০০ ট্যানারি আছে। এর মধ্যে দেশ স্বাধীনের পর গড় ওঠা ট্যানারির সংখ্যা ১৫-২০টির বেশি হবে না। দেশে স্বাধীনের আগেই হাজারীবাগে গড়ে ওঠা ট্যানারি একে একে পার করেছে ৬৭ বছর। শনিবার (৮ এপ্রিল) গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের মধ্য দিয়ে যার সমাপ্তি ঘটল।
এখন সবকিছু ঠিক থাকলে সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরী থেকেই ট্যানারির সকাল কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। আর হাজারীবাগের ট্যানারির স্থান হবে ইতিহাসের পাতায়। সেই সঙ্গে অনেক শ্রমিকের স্মৃতির পাতায় স্থান পাবে হাজারীবাগের ট্যানারি। বর্তমানে ট্যানারির সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। এদের অধিকাংশই পাঁচ বছরের অধিক সময় কাজ করছেন। ১৫-২০ বছর ধরে কাজ করছেন এমন শ্রমিকের সংখ্যাও কম নয়।
দীর্ঘদিন হাজরীবাগে কাজ করা শ্রমিকদের ট্যানারির প্রতি যেমন মায়া জন্মেছে, তেমনি মায়া জম্মেছে হাজারীবাগের উপরও। এখন তাদের ছাড়তে হবে সেই মায়ার বাঁধন। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের কারণে হাজারীবাগের ট্যানারির উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় কেউ কেউ বেকার হওয়ার শংকায় ভুগছেন।
শনিবার হাজারীবাগের গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা কারখানাগুলোর ভেতর ঘুরে দেখা গেছে, কারখানাগুলোতে আগের মতোই চামড়ার স্তূপ রয়েছে। সেই সঙ্গে যেখানে যে মেশিন স্থাপন করা ছিল, সেখানে তা আগের অবস্থায় রয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ ছাড়া হাতের সাহায্যে যেসব কাজ করা হয়, তা আগের মতোই স্বাভাবিক নিয়মে চলছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র প্রথম সহ-সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, সাভারের চামড়া শিল্পনগরী পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর বাস্তবসম্মত নয়।
শহীদ ট্যানারির শ্রমিক মো. সুমন বলেন, ভাই কী আর বলবো, রাতে ঘুমাইতে পারি না। ২০ বছর ধরে হাজারীবাগের ট্যানারিতে কাজ করছি। এখন আর এখানে কাজ করতে পারব না। এই হাজারীবাগের সঙ্গে কতো স্মৃতি রয়েছে। আমি ছোট থেকেই বড় হয়েছি এখানে। এখন হাজারীবাগ ছাড়তে হবে। গভীর রাতে এসব কথা চিন্তা করলে চোখে পানি এসে যায়। আমাদের কথা কে শুনবে বলেন। সবাই গরীব মারার ফন্দি করে। মালিকদের তো কিছু হবে না। তাদের সবকিছুই ঠিকঠাক চলবে।
বগুড়ার সালেহা বেগম দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন হাজারীবাগের ট্যানারিতে। মাত্র ৯০০ টাকা মাসিক বেতনে কাজ শুরু করা এ নারী বর্তমানে এপেক্স ট্যানারিতে মাসিক ছয় হাজার টাকা বেতন পান। হাজারীবাগের নানা স্মৃতি তুলে ধরে সালেহা বলেন, ‘স্যার আমরা কই যামু, কী খামু? মালিক-গো তো অনেক টাকা আছে, তাগো সমস্যা হবে না। আমরা তো বেকার হয়ে যাবো। আয় না থাকলে সংসারে অশান্তি নেমে আসবে।’
এপেক্স ট্যানারির অপর শ্রমিক বরিশালের সাহিদা বলেন, ‘স্যার আমাদের কথা কে শুনব? গরিবের কথা কেউ শোনে না। দুইডা মাস পাইলে আমরা বেতন ও ঈদের বোনাসটা পাইতাম। এখন কাজ বন্ধ হয়ে গেলে ঈদের বোনাস তো পাব না। বেতনও আটকে যেতে পারে।’
ফিনিশ লেদার (চামড়া) সরবরাহ করা রবিন এন্টারপ্রাইজের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি প্রতিমাসে ৩০ হাজার স্কয়ার ফিট চামড়া সরবরাহ করি, যার বাজার মূল্য প্রায় ২৫ লাখ টাকা। হাজারীবাগের ট্যানারি বন্ধ করে দিলে আমার মতো অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিপদে পড়ে যাবে। বিভিন্ন কোম্পানিতে বকেয়া পড়া টাকা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এপেক্স ফুটওয়্যারের কাছে আমার ৪০ লাখ টাকার মতো পাওনা রয়েছে। এখন এ টাকা পাব কিনা সন্দেহ আছে!
রুমা ট্যানারির বাদল ও তরুন বলেন, আমাদের দুই মাসের (ফেব্রুয়ারি ও মার্চ) টাকা একসঙ্গে দেয়ার কথা। সামনে ঈদ, বোনাসও দেবার কথা। কিন্তু এখন ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেলে বকেয়া বেতনতো পাবই না, ঈদের বোনাসও মার গেল।
‘সরকার তো অনেক সময় দিয়েছে। আমাদের আর দুটা মাস দিলে কী সমস্যা ছিল। আমরা বেতন-বোনাসটা পাইতাম। কিন্তু এখন আর কিছুই পাব না। তবে সরকারের কাছে দাবি, আমাদের বকেয়া টাকা আদায়ে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং আমাদের কাজের ব্যবস্থা করা হয়’- বলেন বাদল।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা কাজ না করতে পারলে মাল ডেলিভারি দিতে পারব না। আর মাল ডেলিভারি দিতে না পারলে বেতন দিব কিভাবে? আমরা বারবার সরকারকে বলেছি সাভারে গ্যাস সংযোগ দেয়ার জন্য। কিন্তু এখনও সেখানে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়নি। আমরা কাজ করব কিভাবে?
পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. রইছউল আলম মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, আদালতের নির্দেশে আমরা হাজারীবাগের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছি। রোববার দুপুরের আগেই সকল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আদালতে প্রতিবেদন দেয়া হবে।
এমএএস/এসআই/এমএআর/জেআইএম