সোনালী ব্যাংকে ৫শ’ কোটি টাকার অডিট আপত্তি


প্রকাশিত: ০১:৫৪ পিএম, ১৯ জুলাই ২০১৬

রাষ্ট্রায়ত্ত্ প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের প্রায় ৫০৭ কোটি ১৮ লাখ ৫১ হাজার ২৬৬ টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রকল্প ঋণ দেখিয়ে ‘মুন্নু ফেব্রিক্স’র মাধ্যমেই গায়েব করে দেয়া হয়েছে ১৪৩ কোটি ৪৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ব্যাংকটির ঋণ পুনঃতফসিল ও সুদ কার্যক্রমের ২০০৯-১০ অর্থবছরের হিসাবের উপর বাংলাদেশের মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের উপস্থাপিত বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্লেজ ঋণের ঘাটতি মালামালের মূল্য নগদে আদায় ছাড়াই আসল ও সুদসহ বারবার ব্লক ঋণে রূপান্তর এবং প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট আদায় না করে পুনঃতফসিলীকরণ ও পর্যাপ্ত সহায়ক জামানত গ্রহণ না করে পুনরায় সিসি প্লেজ ঋণ নবায়নের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

কমিটির সভাপতি ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সভাপতিত্বে মঙ্গলবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে অংশ নেন কমিটির সদস্য মো. আব্দুস শহীদ, মোহাম্মদ আমানউল্লাহ, পঞ্চানন বিশ্বাস, মো. অফসারুল আমীন, রেবেকা মমিন, মইন উদ্দীন খান বাদল, এ কে এম মাঈদুল ইসলাম এবং রুস্তম আলী।

এসময় সিঅ্যান্ডএজি মাসুদ আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্লেজ ঋণের ঘাটতি মালামালের মূল্য নগদে আদায় ছাড়াই আসল ও সুদসহ বারবার ব্লক ঋণে রূপান্তর করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট আদায় না করে পুনঃতফসিলীকরণ ও পর্যাপ্ত সহায়ক জামানত গ্রহণ না করে পুনরায় সিসি প্লেজ ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। এতে ব্যাংকের ৬১ কোটি ৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অমান্য করে যেসব কর্মকর্তা ঋণ পুনঃতফসিল করার সঙ্গে জড়িত তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ, ঋণ গ্রহীতার জমাকৃত অর্থ ব্যাংকের হিসাবে নগদায়ন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তত্ত্বাবধান জোরদার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যাতে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে পুনরায় ঋণ গ্রহণ না করতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অন্যান্য ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিষয়টি অবহিত করার সুপারিশ করেছে।

এদিকে ব্যাংকের দায়বদ্ধ মালামাল ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই বিক্রি করে দেয়ার দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, কারো অনুমতি ছাড়াই দায়বদ্ধ মালামাল বিক্রয় এবং ঋণ হিসাবে জমা না করে ব্যাংকের ২০ কোটি ১২ লাখ ৯৬ হাজার ৭৪৬ টাকা ক্ষতি করা হয়েছে। ব্যাংকের প্লেজ ঋণের দায়বদ্ধ মালামাল ব্যাংকের অগোচরে বিক্রয় করা সত্ত্বেও এবং অনাদায়ী পিএসসি প্লেজ ঋণের টাকা আদায় না হওয়ার পরও ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণ ও নবায়ন করার মাধ্যমে ব্যাংকের ক্ষতি করা হয়েছে ১১ কোটি ৬২ লাখ ৩৫ হাজার ১৮১ টাকা। স্টকলটকৃত মালামাল রফতনির মাধ্যমে সমন্বয়ের শর্ত আরোপ না করে মেয়াদি ঋণে পরিণত এবং ঘাটতি মালামালের মূল্য আদায় না করে পুনঃতফসিলীকরণ ও ঋণ পরিশোধের কিস্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ব্যাংকের ক্ষতি করা হয়েছে ৭০ কোটি ২০ লাখ ২০ হাজার ৮১৩ টাকা এবং শাখা ব্যবস্থাপক ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে মেসার্স এইচ এস ফ্যাশন লিমিটেড ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপন এবং মালামাল রফতানি না করে ঋণের টাকা অন্য খাতে বিনিয়োগ ও অনিয়মিতভাবে পুনঃতফসিলীকরণ সত্ত্বেও দায় আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংকের আরও ৩৬ কোটি ৩০ লাখ ১০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।

কমিটি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, অনাদায়ী টাকা আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দায়ী প্রতিষ্ঠান যাতে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে পুনরায় ঋণ গ্রহণ না করতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অন্যান্য ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিষয়টি অবহিত করার পাশাপাশি অনধিক ৩০ দিনের মধ্যে বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করে অডিট অফিসের মাধ্যমে কমিটিকে বিষয়গুলো অবহিত করার সুপারিশ করেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, স্টকলটকৃত মালামালের মূল্য ঋণ হিসেবে জমাকরণে ব্যর্থ ও পুনঃতফসিলীকরণ কার্যকর না হওয়া সত্ত্বেও ডাউন পেমেন্ট আদায় না করে পুনঃতফসিলীকরণ করা হয়েছে। এতে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ৩৭ কোটি ৪১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। পুনঃতফসিলীকরণ ও ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপনের সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি আমদানিকৃত মালামাল রফতনি না করায় ক্ষতি হয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ ২ হাজার ৬৩৭ টাকা, রফতানি সামর্থ্য যাচাই না করে মেসার্স নাসের গার্মেন্টস ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপন এবং রফতানি ব্যর্থতাজনিত কারণে সৃষ্ট ফোর্সডলোনসহ প্রকল্প ঋণ, সিসি হাইপো ও এলটিআর ঋণের দায় আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৯৪ কোটি ৫৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩০ টাকা, পুনঃতফসিলীকরণ সত্ত্বেও প্রকল্প ঋণের নিয়মিত কিস্তির টাকা আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার পরও আমদানি এলসি স্থাপন করে আরও দায় সৃষ্টি এবং প্রকল্প বন্ধ থাকায় মেসার্স মুন্নু ফেব্রিক্স’র ঋণ বাবদ ব্যাংকের ক্ষতি ১৪৩ কোটি ৪৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এবং ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপনের মাধ্যমে আমদানিকৃত মালামাল রফতানি না করে গ্রাহক বিক্রি করে দেয়ার পরও সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে পুনঃতফসিলীকরণসহ রফতানি ব্যবসার সুযোগ দেয়া তাদের। এর মাধ্যমে ব্যাংকের ৮ কোটি ৭৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ক্ষতি করা হয়েছে।

এছাড়া পুনঃতফসিল সুবিধা আর প্রদান না করা ও ঋণের দায় পরিশোধের অঙ্গীকারনামা থাকা সত্ত্বেও পুনঃতফসিলীকরণের শর্ত লঙ্ঘন করে অনিয়মিতভাবে একাধিকবার পুনঃতফসিলীকরণের সুবিধা অনুমোদন করায় এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যর্থতার কারণে ব্যাংকের ১৬ কোটি ৬৭ লাখ ৫৩ টাকা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু থাকার পরও প্রকল্প ঋণ হিসাব অবলোপন ও আইনগত ব্যবস্থা না করা সত্ত্বেও এবং কষ্ট অব ফান্ড কভার না করে সুদ মওকুফ করায় ব্যাংকের ১ কোটি ১৭ লাখ ৪৮ হাজার ২০৬ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কমিটি দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, দায়েরকৃত মামলার তদারকি জোরদারকরণ এবং অনধিক ৬০ দিনের মধ্যে বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করে অডিট অফিসের মাধ্যমে কমিটিকে অবহিত করার নির্দেশ দিয়েছে।

এইচএস/একে/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।