করহার যৌক্তিকীকরণ ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আনতে হবে

ইব্রাহীম হুসাইন অভি
ইব্রাহীম হুসাইন অভি ইব্রাহীম হুসাইন অভি
প্রকাশিত: ১২:৫৭ পিএম, ০৬ এপ্রিল ২০২৫

ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত ৩৭ শতাংশ করের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হওয়া উচিত পণ্যের দাম কমাতে ক্রেতারা যে চাপ দিবে তা সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা।

কারণ ১০ ডলারের মধ্যে ৩ দশমিক ৭ ডলার তাকে কর দিতে হবে। নতুন কর হার কার্যকর হওয়ার পর ১০ ডলারের একটি পণ্য ১৩ দশমিক ৭ ডলারে বিক্রি করতে হবে। ফলে তারা চেষ্টা করবে পুরোটাই রপ্তানিকারকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে। এ কাজটি সম্মিলিতভাবে ও দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে বলে মতামত দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন করের প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে নিজের সুপারিশ তুলে ধরছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের বিশেষ প্রতিবেদক ইব্রাহীম হুসাইন অভি

জাগো নিউজ: নতুন শুল্ক কি বাণিজ্য যুদ্ধ উসকে দিবে?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

ড. জাহিদ হোসেন: বাণিজ্য যুদ্ধের ঘণ্টা বেজে গেছে। বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এখন আর এটা আশঙ্কার মধ্যে নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প গুলি ছুঁড়ে দিয়েছেন। ছোটখাটো গুলি নয়, মিসাইল ছেড়েছেন। বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোর বিরুদ্ধে বড় ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কারণ এ অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর বেশি কর আরোপ করা হয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকার দিকে কম। কানাডার ক্ষেত্রে যতটা ভাবা হয়েছিল তার কিছুই হয় নাই।

চীনের শুল্কহার ৩৪ শতাংশ, ভারতের ২৬ শতাংশ, পাকিস্তান ২৯ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ৩২ শতাংশ। এশিয়ার দেশগুলোর ওপর প্রভাব অনেক বেশি হবে। চীন, ভারত, কোরিয়া এ সব বড় বড় দেশের ওপর ব্যাপক হারে কর বসানো হয়েছে।

যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর কিছুটা কম বসানো হয়েছে। তারপরেও সেটা এক ধরনের প্রভাব ফেলবে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: যে সব দেশের ওপর কর আরোপ করা হয়েছে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?

ড. জাহিদ হোসেন: যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট নয় এবং বোঝা যাচ্ছে না। এখনো সবাই চুপ আছে এবং সংযত আচরণ করছে। পরবর্তী পদক্ষেপ দেখে বোঝা যাবে আসলে বিশ্ব বাণিজ্যিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিবে।

বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিগুলো পরিস্থিতি অবজার্ভ করছে। পরিস্থিতি নিয়ে তারা ইমিডিয়েট কোনো অ্যাকশনে যায়নি। তারা এটা বুঝবে। তারপরে হয়তো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পদক্ষেপ নিবে।

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ নিতে পারে?

ড. জাহিদ হোসেন: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাৎক্ষণিক অ্যাকশন হওয়া উচিত মূল্য কমানোর জন্য ক্রেতারা যে চাপ দিবে তা মোকাবেলা করা। কারণ ১০ ডলারে ৩ দশমিক ৭ ডলার তাকে ট্যাক্স দিতে হবে। নতুন কর হার কার্যকর হওয়ার পর ১০ ডলারের একটি পণ্য ১৩ দশমিক ৭ ডলারে বিক্রি করতে হবে। ফলে তারা চেষ্টা করবে পুরোটাই রপ্তানিকারকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে।

আমাদের কাজ হবে বর্ধিত করের বোঝা ক্রেতাদের ওপরে চাপানো। এটা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। সম্মিলিত ও সংঘবদ্ধভাবে ক্রেতাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করতে হবে। একক কোনো কোম্পানির পক্ষে সম্ভব হবে না এবং আলোচনা থেকে অর্জন করা কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রে সবাইকে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে একত্রে নেগোসিয়েশন করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

যদি একটি কোম্পানি শুধু বৈশ্বিক ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে, তাহলে দর কষাকষি থেকে লাভ করা বেশ অসুবিধাজনক হবে। একটি বাণিজ্য সংস্থা হিসেবে বিজিএমইএকে তার সদস্যদের সম্মিলিতভাবে সমস্যা মোকাবিলার নির্দেশ দিতে হবে। অন্যদিকে, সদস্যদের বলতে হবে শিল্পের স্বার্থে তারা বিজিএমইর নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারবেন না।

বৈশ্বিক পোশাক ব্র্যান্ডগুলো নতুন করের বোঝা তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইবেন। নতুন কার্যাদেশ দেওয়ার সময় তারা দাম কমানোর দাবি জানাবেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকদের পক্ষে এটা বহন করা সম্ভব নয়। কারণ মার্জিন কম এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হবে না। কারণ তার রাজস্ব আদায় কম।

এই শুল্কের বোঝা আমরা বহন করতে পারবো না, দিতে পারবো না। কারণ আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল। সরকার সাপোর্ট দিতে পারছে না, যেটা অন্যান্য দেশ দিতে পারছে। আমাদের সে সক্ষমতা নাই। কারণ সরকারের রাজস্ব আয় ভালো না এবং সহায়তা দেয়া সম্ভব নয়।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। নতুন ইনভেস্টমেন্ট কম এবং কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। ফলে কোনোভাবেই এ বর্ধিত করের বোঝা আমাদের দ্বারা বহন করা সম্ভব হবে না। এ বর্ধিত করের বোঝা চাপিয়ে দিলে অনেক ছোট কারখানা এবং মাঝারি কারখানা বন্ধের হুমকিতে পড়তে পারে।

জাগো নিউজ: কী ধরনের নীতি পরিবর্তন প্রয়োজন?

ড. জাহিদ হোসেন: ট্রাম্প প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে আমেরিকার পণ্য প্রবেশে ৭৪ শতাংশ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এ দাবি যৌক্তিক এবং ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

বিজ্ঞাপন

কাস্টম ডিউটি, অ্যাডভান্স ভ্যাট, অ্যাডভান্স ট্যাক্স, রেগুলেটরি ডিউটি এবং সব যদি হিসাব করা হয় তাহলে সেটা ৩০ শতাংশের কাছাকাছি বা তার চেয়ে বেশি হতে পারে। সুতরাং এটা ফেলে দেওয়ার নয়।

অশুল্ক বাধা বা নন ট্যারিফ ব্যারিয়ারের কারণে ব্যবসার যে খরচ বাড়ে সেটা যদি যোগ করা হয় তাহলে শুল্ক সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। সুতরাং তাদের কর হার কমানোর একটা পদক্ষেপ নিতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবসার পরিবেশ উন্নতির জন্য কী কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো উল্লেখ রয়েছে ইউএসটিসির বক্তব্যে।

সুতরাং ৭৪ শতাংশ কর কমানোর জন্য আমরা এই এই সংস্কার নিয়েছে এবং উদ্যোগগুলো দেখিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে। আরো সুবিধা হয় যদি আমরা বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে মিলে এই ট্যাক্স রেট মোকাবিলা করার জন্য একটা যৌথ পদক্ষেপ নিতে পারি। কিন্তু সেটা ট্রাম্প একেবারেই অপছন্দ করেন এবং তিনি মাল্টিলেটারাল নেগোসিয়েশনে যেতেই চান না।

ট্রাম্পকে না খেপিয়ে চতুর হতে হবে এবং কৌশলে বিষয়টাকে হ্যান্ডেল করতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে কীভাবে মোকাবিলা করা যেতে পারে সে বিষয়ে নজর দেওয়া যেতে পারে।

৭৪ শতাংশ ট্যারিফ নামিয়ে যদি ৪০ শতাংশে আনা যায় তাহলে এবং প্যারাট্যারিফগুলো কমিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আলোচনা ফলপ্রসূ হবে এবং সেখান থেকে কিছু অর্জন সম্ভব হবে।

ইউএসএ থেকে আমদানিকৃত তুলা জিরো ট্যারিফ করে বন্ডেড ওয়্যারহাউস ফেসিলিটিসের মাধ্যমে আনা যেতে পারে। এটা শুল্ক কমানোর একটা পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে।

তারা চাচ্ছে ডিউটি রিডাকশন। আমরা যদি পলিসি রিফর্ম করে তাদের বলে দিতে পারি যে আমরা আমাদের কাজ করে দিয়েছি, তাহলে তারা সিদ্ধান্ত নিবে তারা কীভাবে এখানে এক্সপোর্ট করবে কিংবা বিনিয়োগ করবে।

ট্রাম্পের কথা হলো ডিউটি কমান। তিনি ডিউটি কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত চাচ্ছেন।

জাগো নিউজ: ট্রাম্পের কর আরোপ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইনের ব্যত্যয় নয় কি?

ড. জাহিদ হোসেন: ট্রাম্প নিজেই নিয়ম তৈরি করে (ট্রাম্প মেইকস হিজ ওউন রুলস) তিনি ডব্লিউটিওকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এইগুলো করেছেন। অন্য কোনো রাষ্ট্র ডব্লিউটিওর অনুমতি ছাড়া এ ধরনের কাজ করতে পারবে না। চীন কিংবা রাশিয়া হয়তো করতে পারবে। কারণ তাদের শক্তির কারণে, তাদের বড় অর্থনীতি এবং নিজস্ব ক্যাপাসিটি রয়েছে বলে।

কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পক্ষে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর সেটা করতে গেলে ডব্লিউটিওর অন্যান্য সদস্য দেশের অনুমতি সাপেক্ষে করতে হবে।

ট্রাম্প কোনো তোয়াক্কাই না করে নিজের মতো করে ট্যাক্স আরোপ করেছেন এবং তিনি যুক্তিসঙ্গতভাবে করেননি।

জাগো নিউজ: ট্রাম্পের নতুন কর যুদ্ধ বৈশ্বিক বাণিজ্যে কি প্রভাব ফেলতে পারে?

ড. জাহিদ হোসেন: শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্ব মন্দার আশঙ্কাটা অনেক বেড়ে গেছে। নতুন করের হার মার্কিন বাজারে মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দেবে। ফলস্বরূপ, মানুষ ভোগ্যপণ্য কম খরচ করবে এবং ক্রয় ক্ষমতায় ধস নামবে। চূড়ান্তভাবে, এটি পণ্যের চাহিদা কমিয়ে দেবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরবরাহকারী দেশগুলো। সারা পৃথিবীজুড়ে উৎপাদন কমবে। মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে না বরং কর্মচ্যুতি ঘটবে।

কিন্তু ট্রাম্প এসব বিষয় বিবেচনা করে করেননি। তিনি মনে করেন কর বাড়িয়ে অর্থনীতি চাঙা করে ফেলবেন।

জাগো নিউজ: সরকার রপ্তানিকারকদের কোনো সুবিধা দিয়ে সহায়তা করতে পারে কি?

ড. জাহিদ হোসেন: ব্যবসায়ীদের ভর্তুকি দিয়ে সমস্যার সমাধান করলে অবস্থা আরো খারাপ হবে। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ তখন ট্রাম্প প্রশাসন বলতে পারে যে আমরা সহায়তা বা সাবসিডি আরো বাড়িয়েছি। প্রটেকশন আরো বাড়িয়ে দিয়েছি।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

সুতরাং, আমাদের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে হবে। করহার যৌক্তিকীকরণ ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করতে হবে।

আইএইচও/এমএমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।