বাজেটে তিন ‘পদচিহ্ন’ রেখে যেতে পারে সরকার

একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে বিনিয়োগ না হওয়ায় হচ্ছে না কর্মসংস্থান। এমন পরিস্থিতিতে নতুন অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট দিতে হবে সরকারের। এই বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানো, বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রাজস্ব আহরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার তিনটি ‘ফুটপ্রিন্ট’ বা ‘পদচিহ্ন’ রেখে যেতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, কোন বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে এবং কীভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক এ অভিমত ব্যক্ত করেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ শিপন।
জাগো নিউজ: আগামী বাজেটে চ্যালেঞ্জগুলো কী হবে? কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
এম এম আকাশ: দুটি সমস্যায় সমগ্র জাতি কষ্ট ভোগ করছে। একটা হলো মূল্যস্ফীতি, আরেকটা প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না, বিনিয়োগ হচ্ছে না এবং কর্মসংস্থান বাড়ছে না। আগামী বাজেটের জন্য এগুলো বড় চ্যালেঞ্জ ও এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
জাগো নিউজ: মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা যায়?
এম এম আকাশ: মূল্যস্ফীতি অনেক ওপরে উঠে এখন একটু কমতে শুরু করেছে। কিন্তু এখনো যে পর্যায়ে আছে সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে কিনে খাওয়া কঠিন। আর রোজার পর কী দাঁড়ায় সেটাও অনিশ্চিত। যেহেতু সবজির মৌসুম ছিল, সে কারণে দাম কম ছিল। কিন্তু চালের দাম কমেনি। তার মানে মূল্যস্ফীতির সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, এ রকম ভাবা ঠিক নয়। এটাকে মোকাবিলা করতে হবে।
মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য যেসব পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে গ্যাপ আছে, মানে সরবরাহের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি, সেসব পণ্য আমদানি করে হোক বা অন্য কোনোভাবে সংগ্রহ করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো প্রয়োজনীয় মাত্রায় বাজারে যা সরবরাহ হবে, তার এক-তৃতীয়াংশ সরকারের গুদামে মজুত রাখতে হবে, যাতে দাম বাড়লে সরকার সেটা বাজারে ছেড়ে দাম কমাতে পারে। আর দাম কমে গেলে সরকার কিনবে উৎপাদকের কাছ থেকে।
আরও পড়ুন
- ঈদ বাজারে পোশাকেই ব্যয় ৮০ শতাংশ
- টালমাটাল সোনার বাজার, ঈদের পর অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধের আশঙ্কা
- মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দিলে রাজস্ব না বেড়ে কমবে
- ট্যাক্স বাড়ালে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন
১৯৯০ সালে মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে যে টাস্কফোর্স হয়েছিল, এই সুপারিশটা তারাই করেছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সরকার এটা গ্রহণ করেনি। এই সরকার বলছে বাজেটে তারা একটা ‘পদচিহ্ন’ রেখে যেতে চায়। যদি রাখতে চায় এই কর্মসূচিটা চালু করে দিয়ে রাখতে পারে। যদিও পরবর্তীসময়ে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি থাকলে ওটাকে আর কন্টিনিউ (চালু রাখা) করবে না। আবার করতেও পারে। না করলেও ক্ষতি নেই। তারা যে চেষ্টা করেছিল এই রেকর্ডটা থাকলো এবং তাদের পদচিহ্ন মানুষ মনে রাখবে।
কর্মসংস্থান এখন সৃষ্টি হবে না খুব সহজে। কারণ বিনিয়োগ যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ উৎপাদন বাড়বে না এবং কর্মসংস্থান হবে না। বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি নির্ভর করবে নির্বাচিত সরকারের ওপর। কারণ নির্বাচিত সরকার না এলে কেউ সহজে বিনিয়োগ করবে না
জাগো নিউজ: বিনিয়োগ ও কর্মংস্থানের চ্যালেঞ্জ কী এবং কীভাবে মোকাবিলা করা যায়?
এম এম আকাশ: কর্মসংস্থান এখন সৃষ্টি হবে না খুব সহজে। কারণ বিনিয়োগ যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ উৎপাদন বাড়বে না এবং কর্মসংস্থান হবে না। বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি নির্ভর করবে নির্বাচিত সরকারের ওপর। কারণ নির্বাচিত সরকার না এলে কেউ সহজে বিনিয়োগ করবে না। কারণ, সবাই ভাববে কোন সরকার ক্ষমতায় আসবে, এটা তো অনিশ্চিত।
অথবা নির্বাচন হয় কি না, জরুরি অবস্থা দিয়ে সামরিক বাহিনী কন্টিনিউ করে কি না বা একটা কেওয়াজ (গণ্ডগোল) লেগে যায় কি না, তারপর ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের যে মৈত্রী তার ফলে তাদের সঙ্গে সরকারের পররাষ্ট্রনীতি ও বাণিজ্যনীতিতে যেসব সমস্যার উদ্ভব হতে পারে, চীনের প্রতি ঝুঁকলে যেসব ব্যাপার হতে পারে- এসব কারণে ব্যবসায় অনেক অনিশ্চয়তা। এই অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ সহজে হবে না। তার মানে কর্মসংস্থানও সহজে হবে না।
ওয়ান/ইলেভেনের সময় আজিজুল ইসলাম সাহেব (এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম) একটা প্রোগ্রাম করেছিলেন ১০০ দিনের গ্যারান্টি কর্মসংস্থান। তখন এটা করা হয়েছিল গ্রামে। বর্তমান সরকার এটা গ্রাম ও শহরে করতে পারে। হালকা মৌসুমে সরকার ১০০ দিনের কাজের ব্যবস্থা করবে, এতে অবকাঠামোর কাজ হলো এবং তার অন্য জায়গায় চাকরি না হলেও অন্তত তিন মাসের জন্য এখানে কাজের সুযোগ পেলো। নগর ও গ্রামের মানুষের জন্য এটা করা যেতে পারে। এটা করা গেলে এটাও একটা পদচিহ্ন হতে পারে।
গ্রামীণ এলাকায় অনেক লোক বেকার হয়ে যাচ্ছে। বেকার হয়ে যারা চুরি-ডাকাতি করছে বা ফেরি করছে অথবা কম খেয়ে অর্ধভুক্ত থেকে দিন কাটাচ্ছে, তাদের জন্য এই কর্মসংস্থান প্রোগ্রামটা করতে পারে সরকার। আর একটা করা যেতে পারে মোবাইলের মাধ্যমে গরিব মানুষকে নগদ অর্থ দেওয়া। করোনার সময় যেমন দেড় কোটি মানুষকে দেওয়া হয়েছিল। এগুলো বাজেটে থাকা উচিত।
জাগো নিউজ: রাজস্ব আহরণ চ্যালেঞ্জ হবে কি?
এম এম আকাশ: রাজস্ব আহরণ আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ। আমার সুপারিশ যাদের দুটির বেশি বাড়ি আছে, যাদের দুটির বেশি গাড়ি আছে এবং যাদের ব্যাংকে ক্যাশ ডিপোজিট এক কোটি টাকার বেশি তাদের সহজে চিহ্নিত করা যায় এবং চিহ্নিত করলে তাদের ওপর ডাইরেক্ট (প্রত্যক্ষ) একটা সাপ্লিমেন্টারি ট্যাক্স (সম্পূরক শুল্ক) বসানো যায়।
হালকা মৌসুমে সরকার ১০০ দিনের কাজের ব্যবস্থা করবে, এতে অবকাঠামোর কাজ হলো এবং তার অন্য জায়গায় চাকরি না হলেও অন্তত তিন মাসের জন্য এখানে কাজের সুযোগ পেলো। নগর ও গ্রামের মানুষের জন্য এটা করা যেতে পারে। এটা করা গেলে এটাও একটা পদচিহ্ন হতে পারে
এমনিতেই তাদের ওপর ট্যাক্স আছে। কিন্তু অনেকেই এ রকম হওয়া সত্ত্বেও ট্যাক্স দিচ্ছে না। সুতরাং, যারা ট্যাক্স দিচ্ছে না, তাদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। এভাবে সম্পদ ট্যাক্স আদায় করতে পারলে প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়বে এবং পরোক্ষ করের আওতা কমবে। পরোক্ষ করের মাধ্যমে টাকা আদায় করলে, সেটা আবার সেই জনগণের মাথায় পড়বে। আর প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে করলে, সেটা পড়বে আমাদের শীর্ষ ৫ শতাংশের ওপর।
এসব নতুন ফুটপ্রিন্ট বা পদচিহ্ন এই সরকারেই রাখতে পারে। কারণ, এই সরকার কোনো কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না বলে তারা দাবি করছে। যদি তাই হয়, তাহলে তারাই করতে পারে। এখন তো নতুন দল যেটা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তারাও বলছে- টাকাওয়ালাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমাদের প্রোগ্রাম করতে হচ্ছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ তো তাই করতো। তাহলে খুব একটা পরিবর্তন তো আমি দেখছি না ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকারের মধ্যে।
এমএএস/এএসএ/এমএস