ডিম দিতে এসেও রক্ষা হচ্ছে না কচ্ছপের

সায়ীদ আলমগীর
সায়ীদ আলমগীর সায়ীদ আলমগীর কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০৪:৪৭ পিএম, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
সমুদ্র তীরে ভেসে আসছে একের পর এক মৃত্যু কচ্ছপ, যা গবেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে

দু-তিন দশক আগের কক্সবাজার উপকূল এখন অনেকাংশে বদলে গেছে। বদলেছে জীবনাচার ও প্রাণ-প্রকৃতি। সমুদ্র এবং নদী তীর ভাঙনের কবলে পড়ে আবাস হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। সেই সঙ্গে আছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এমনকি প্রজননের জন্য সমুদ্র তীরের বেলাভূমিতে আসার পথে জেলেদের জালে আটকা পড়ছে সাগরের ‘ক্লিনার’ হিসেবে পরিচিত অসংখ্য মা কচ্ছপ। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ কথা, এসব কচ্ছপের মৃত্যুর মিছিল র্দীঘ হচ্ছে।

গত সপ্তাহে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক মা কচ্ছপের মরদেহ উদ্ধার করে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিওআরআই-বোরি)। টেকনাফ, উখিয়া, রামুর হিমছড়ি, কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক বেলাভূমির তীর থেকে মৃত কচ্ছপগুলো উদ্ধার করা হয় বলে জানান বোরির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, স্থানীয়রা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বিভিন্ন এলাকায় কচ্ছপের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে আমাদের খবর দেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহগুলো উদ্ধার করি। এগুলো জলপাই রঙের বা অলিভ রিডলি প্রজাতির। সুরতহাল করার পর বালিচাপা দেওয়া হয়।

ডিম দিতে এসেও রক্ষা হচ্ছে না কচ্ছপের
বালুচাপা দেওয়া হচ্ছে মৃত্যু কচ্ছপদের

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বোরির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া জানান, ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা চারদিন টেকনাফের সাবরাং জিরো পয়েন্ট থেকে উখিয়া উপজেলার রূপপতি, সোনারপাড়া, পেঁচারদ্বীপ ও হিমছড়ি পর্যন্ত স্থান থেকে ৭০টি মৃত কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়। ২৮ জানুয়ারি একদিন বিরতি দিয়ে ২৯ জানুয়ারি শেষ দফার অনুসন্ধানে নাজিরারটেক থেকে পেঁচারদ্বীপ-মংলাপাড়া পর্যন্ত স্থান থেকে আরও ১৪টি মৃত কচ্ছপ পাওয়া যায়।

তিনি বলেন বোরির পাঁচ সদস্যের গবেষণা দল প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা পায়ে হেঁটে সার্ভে করে। গবেষক দলের উদ্ধার কচ্ছপের বেশিরভাগ ছিল অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙ্গের সামুদ্রিক কচ্ছপ। অধিকাংশের পেটে ছিল ডিম। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের পর এগুলো বালিচাপা দেওয়া হয়। সবগুলো কচ্ছপ সম্প্রতি সময়ে মারা গেছে এমন নয়। দুই মাস আগে মারা গেছে এমন কচ্ছপও রয়েছে। আমরা অনেকগুলোর কঙ্কাল পেয়েছি। গত ২৪ দিনে শতাধিক মৃত কচ্ছপ ভেসে এসেছে।

২০২৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্টে ২৯টি মৃত কচ্ছপ পাওয়া গিয়েছিল বলে জানান বৈজ্ঞানিক এই কর্মকর্তা। ফলে প্রজনন মৌসুমে এত সংখ্যক কচ্ছপের মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে গবেষকদের। এভাবে কচ্ছপের মৃত্যু, তাদের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

ডিম দিতে এসেও রক্ষা হচ্ছে না কচ্ছপের

বোরির তথ্যমতে, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম। এসময় মা কচ্ছপ উপকূলে ডিম পাড়তে আসে। তখন অনেক কচ্ছপ উপকূলে বসানো জেলেদের জালে আটকে এবং সমুদ্রে চলাচলকারী নৌযানের ধাক্কায় মারা যায়। তবে তদন্তের পর কচ্ছপগুলোর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা সম্ভব হবে।

সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের সোনাদিয়া, হিমছড়ি, সোনারপাড়া, ইনানী ও টেকনাফ সৈকতে অন্তত ২৯টি মৃত কচ্ছপ পাওয়া যায়। এ সময়ের মধ্যে তিনটি মৃত ডলফিনও ভেসে এসেছিল।

বিজ্ঞাপন

প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) বলছে, সামুদ্রিক মা কচ্ছপ এখন মহাবিপদে রয়েছে। ১০ বছর আগে ২০০৩ সালে সংস্থাটির এক জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার উপকূলের ৫২ পয়েন্টে কচ্ছপ ডিম দিতে আসতো। ওই সময় এসব পয়েন্ট মা কচ্ছপের কাছে ছিল নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

ডিম দিতে এসেও রক্ষা হচ্ছে না কচ্ছপের

নেকমের উপপ্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমান বলেন, ১০ বছর আগে ৫২ পয়েন্টে মা কচ্ছপ ডিম দিতে এলেও বর্তমানে কমে ৩৪ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। মহেশখালীর সোনাদিয়া থেকে শুরু করে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত সৈকতের নির্জন এলাকায় এসব কচ্ছপ ডিম দিত। সমুদ্রপাড়ে ডিম দিতে এসে তাদের পুনরায় গভীর সাগরে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে মা কচ্ছপ।

বিজ্ঞাপন

নেকমের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম বলেন, নির্জন সৈকতে কচ্ছপ ডিম দিতে আসে। নানা কারণে ডিম দেওয়ার স্থানগুলো এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পর্যটনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি কক্সবাজার সৈকতে আলোকায়ন, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়া, ডিম ছাড়ার মৌসুমে বিচ ডাইভিং, খেলাধুলা, সৈকতে হাঁটা ইত্যাদির কারণে কচ্ছপের ডিম দেওয়ার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সৈকতে পুঁতে রাখা অবৈধ কারেন্ট জালের কারণে মা কচ্ছপগুলোর আসা-যাওয়ার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। গভীর সাগরে ট্রলিং জালে আটকা পড়েও মারা যাচ্ছে কচ্ছপ। এমনকি সৈকতে এসে ডিম পারলেও সেই ডিম রক্ষা করা যাচ্ছে না। ডিমগুলো খেয়ে ফেলছে কুকুর। ডিম পাড়তে উঠলেই কচ্ছপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কুকুরের দল।

ডিম দিতে এসেও রক্ষা হচ্ছে না কচ্ছপের

বিজ্ঞাপন

প্রজনন মৌসুমে এভাবে কচ্ছপের মৃত্যুতে উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি এইচ এম এরশাদ বলেন, পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলে ডিম পাড়ার জন্য আসায় বাধা পাচ্ছে কচ্ছপ। অন্যদিকে সন্দীপ, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলে প্রায় ২০ হাজার ট্রলার মাছ ধরতে গভীর সমুদ্র যায়। এরমধ্যে জেলেরা সাগরে ভাসমান, ডুবাজাল, ট্রলারসহ ৪০-৬০ ফুট লম্বা বিহুন্দি ও লাইক্ষ্যা জাল পেতে রাখে। উপকূলের কাছাকাছিও বসানো হয় অনেক টং-জাল। এতে আটকে পড়ে কচ্ছপ।

পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উই ক্যান কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ওমর ফারুক জয় বলেন, প্রতিবছর প্রজনন মৌসুমে মৃত কচ্ছপ পাওয়া যাচ্ছে। এসব কচ্ছপের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকে। সাগরে পুঁতে রাখা মাছ ধরার জালে আটকা পড়লে জেলেরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে কিংবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে কচ্ছপকে হত্যা করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। জোয়ারের পানিতে তা উপকূলে ভেসে এলে কুকুর খেয়ে ফেলে। জেলেদের সচেতন করা, ডিম দেওয়ার স্থানটি নিরাপদ করা এবং সৈকতে কুকুরের বিচরণ রোধ করা জরুরি, তা না হলে কচ্ছপ রক্ষা করা যাবে না।

কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলের প্রকৃতির পরিবর্তন হয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়েছে পুরোনো অনেক গ্রাম। আবার অনেক জায়গায় চর জেগে পাল্টে গেছে নদীর গতিপথ ও উপকূলের তীর। ডিম দিতে তীরে আসার পথে জেলেরা অনেক সময় ঝামেলা মনে করে বাঁশ, কাঠ, লোহাসহ বিভিন্ন কঠিন পদার্থ দিয়ে কচ্ছপ হত্যা করে। পরে এগুলো ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে আসে উপকূলে।

বিজ্ঞাপন

এসব নিয়ন্ত্রণে বোরি এবং মৎস্য কর্মকর্তাদের নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, গতবছরও প্রজনন মৌসুমের এসময় সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট মৃত মা কচ্ছপ ভেসে এসেছিল। তবে গত বছরের তুলনায় এবার মারা পড়ার হার অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে।

সায়ীদ আলমগীর/জেডএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।