ভুয়া জন্মনিবন্ধনে অর্ধকোটি টাকার জালিয়াতি
দেশসেরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচিত হয়েছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার কানিহারী ইউনিয়ন পরিষদ। অথচ এই পরিষদ থেকেই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বুল বুল চৌধুরী নামের এক ব্যক্তির ভুয়া জন্মনিবন্ধন ইস্যু করার অভিযোগ উঠেছে। এর মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে অর্ধকোটি টাকার সম্পদ। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ায় বিতর্ক শুরু হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বুল বুল চৌধুরী হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী ইউনিয়নের দক্ষিণ ডুবাঐ গ্রামের বাসিন্দা। তিনি অনেক আগে ভারতে চলে গেছেন। এরপর আর দেশে আসেননি। জাল সনদে যে জমি বিক্রি হয়েছে তার মূল মালিক ছিলেন ব্রজেন্দ্র কুমার চৌধুরী। উত্তরাধিকারসূত্রে তার তিন ছেলে বানোয়ারি লাল চৌধুরী, বিনয় কুমার চৌধুরী ও ব্রজলাল চৌধুরী স্বত্বাধিকারী হন। বানোয়ারি লাল চৌধুরীর ছেলে বিক্রেতা হিসেবে বুল বুল চৌধুরীর নামের একজনকে সাজিয়ে দলিল তৈরি করেন। অথচ জন্মসনদটি যেমন ভুয়া, বাহুবলের পুটিজুরী ইউপি থেকে নেওয়া ওয়ারিশান সনদও ভুয়া!
আরও জানা যায়, গত বছরের ২৪ এপ্রিল ওই গ্রামের বানোয়ারী লাল চৌধুরী ও শীলা রানী চৌধুরীর সন্তান পরিচয়ে বুল বুল চৌধুরীর নামে ত্রিশালের কানিহারী ইউপি থেকে একটি অনলাইন জন্মনিবন্ধন হয়। এরপর ওই জন্মনিবন্ধন ও পুটিজুরী ইউপি থেকে দেওয়া ওয়ারিশান সনদপত্রের মাধ্যমে ১৭ সেপ্টেম্বর ৫২ শতক জমি (মূল্য প্রায় অর্ধকোটি টাকা) বাহুবল সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিলের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে। যার দলিল নম্বর ২৯৪৫/২৪। ওই জমি কেনেন বাহুবলের শেওড়াতলী গ্রামের মৃত ফিরোজ মিয়ার ছেলে মোবাশ্বির আহমেদ, ভাটপাড়া গ্রামের মৃত আকল মিয়ার ছেলে ছালেক মিয়া ও গাজীপুর গ্রামের নোয়াব উল্লার ছেলে আজির উদ্দিন।
কথা হয় কানিহারী ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা মেহেদী হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘২০২১ সাল থেকে আমি জন্ম নিবন্ধন করি না। কীভাবে কী হয়েছে, আমার জানা নেই।’
তবে একই ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বলেন, ‘আমাদের পাসওয়ার্ড, আইডি ওইসময় হ্যাক হয়েছিল। আমার মনে হয় বুল বুল চৌধুরীর নামে যে আইডি হয়েছে, তা হ্যাক করেই করা হয়েছে।’
কাগজে আপনার সই রয়েছে জানালে তিনি বলেন, ‘আমার সইটি জাল করা হয়েছে। তবে আমার মনে হয়, চেয়ারম্যানের সই ঠিক আছে।’
একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে কানিহারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদ উল্লাহ মণ্ডল বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ঠিকানা ও সচিবের সই ছাড়া আমি কোনো সই দিই না। সব দেখেশুনেই আমি সই দিই। ওই সই আমি দেইনি।’
এদিকে ব্রজলাল চৌধুরী ও বিনয় কুমার চৌধুরীর সন্তানরা উত্তরাধিকার হিসেবে জমি বিক্রি ও দলিল তৈরিকে বেআইনি অভিযোগ করে আদালতে মামলা করেছেন।
ওই জমির উত্তরাধিকার দাবিদার বুল বুল চৌধুরীর চার চাচাতো ভাইবোন। তারা হলেন দক্ষিণ ডুবাঐ গ্রামের ব্রজলাল চৌধুরীর তিন ছেলে পান্না লাল চৌধুরী, হিরক চৌধুরী ও মানিক চৌধুরী এবং বিনয় কুমার চৌধুরীর মেয়ে কৃষ্ণা চৌধুরী। এই চারজন হবিগঞ্জ সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে ৯ জনের বিরুদ্ধে একটি স্বত্ব মামলা করেছেন। জমির দখল নিয়ে তারা অন্তর্বর্তী নিষেধাজ্ঞার আবেদনও করেন। গত ১৯ নভেম্বর আদালত তা মঞ্জুর করেন। মামলায় তিন ক্রেতার পাশাপাশি বুল বুল চৌধুরী, হারুন মিয়া, মিন্টু চন্দ্র চন্দ, দলিল লেখক আব্দুল কাদির মাহমুদ, উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার ও হবিগঞ্জ জেলা সাব-রেজিস্ট্রারকে বিবাদী করা হয়েছে।
বুল বুল চৌধুরীর চাচাতো ভাই হিরক চৌধুরী বলেন, ‘ভুয়া জন্মনিবন্ধন ও ওয়ারিশান সনদের মাধ্যমে একজনকে বুল বুল চৌধুরী সাজিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। রেজিস্ট্রি দলিলে যে ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা বুল বুল চৌধুরীর নয়। যে জমি বিক্রি করা হয়েছে, তা আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া।’
বাহুবলের পুটিজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) আবুল কালাম বলেন, ‘বুল বুল চৌধুরীর নামে ওয়ারিশান সনদটি এই ইউনিয়ন থেকে দেওয়া হয়নি। এটি ভুয়া ওয়ারিশান সনদ। এছাড়া বুল বুল চৌধুরীর মৃত মা শীলা রানী চৌধুরীকে ওয়ারিশান দেখানো হয়েছে। অথচ ওয়ারিশান হিসেবে মৃত শীলা রানী চৌধুরীর নাম উল্লেখ করার কথা নয়।’
বুল বুল চৌধুরীর কাছ থেকে নিয়ম মেনে জমি কিনে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে উল্লেখ করে জমির ক্রেতাদের একজন শেওড়াতলী গ্রামের মৃত ফিরোজ মিয়ার ছেলে মোবাশ্বির আহমেদ বলেন, ‘বেআইনি পন্থায় জমি রেজিস্ট্রি করা হয়নি। কোনো কিছুই ভুয়া নয়। বুল বুল চৌধুরী সশরীরে উপস্থিত থেকে আমাদের জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। মূলত আমার সঙ্গে আক্রোশের বশবর্তী হয়ে বানোয়াট অভিযোগ তুলে অহেতুক মামলা করা হয়েছে।’
বাহুবল উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার মেহেদী হাসান বলেন, ‘রেজিস্ট্রির সময় জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদের একটি হলেই হয়। আমি অনলাইন জন্মনিবন্ধন পেয়েছি; পাশাপাশি ভূমি অফিসের নামজারি ছিল। দলিল করার সময় ছবির সঙ্গে বুল বুল চৌধুরীকে শনাক্ত করা হয়েছে। একজন শনাক্তকারীও ছিলেন। তার জাতীয় পরিচয়পত্রও দেওয়া হয়েছে। যে কারণে আইনিভাবে দলিল সম্পাদনে কোনো ত্রুটি ছিল না।’
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শিবরাজ চৌধুরী বলেন, জালিয়াতির বিষয়ে একটি আপত্তিপত্র পেয়েছি, যা তদন্তাধীন।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জুয়েল আহমেদ সম্প্রতি বদলি হয়েছেন। এ বিষয়ে একই উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঘটনাটি উপজেলা প্রশাসনের নজরে আসার পর ইউএনও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেন। কানিহারী ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নেওয়া ওই জন্মনিবন্ধনটি তদন্ত প্রতিবেদনে ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ভুয়া জন্মনিবন্ধনটি বাতিল করার জন্য সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে।
কামরুজ্জামান মিন্টু/এসআর/এমএস