পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু
‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’য়ের শিকার সাবেক ছাত্রদল নেতা, দাবি পরিবারের
নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া আবদুর রহমান (৩৪) উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন তিনি। পরিবারের দাবি, আবদুর রহমানকে ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) সকালে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় ২৫০ শয্যার নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবদুর রহমান। ওইদিন সকালে গুলি-রামদাসহ তাকে আটক করে থানায় সোপর্দ করে সেনাবাহিনী।
আবদুর রহমানের চাচাতো ভাই আমেরিকা প্রবাসী মো. হানিফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের ভাই অত্যন্ত ভদ্র ছেলে ছিল। তাকে মিস ইনফরমেশনে আটক করে আওয়ামী লীগের ইন্ধনে কন্ট্রাক্ট কিলিং করা হয়েছে। সেনাবাহিনী আটকের সময় আবদুর রহমানকে ব্যাপক মারধর করেছে। পরে থানায় নেওয়ার পর সে বাঁচার জন্য অনেক আকুতি করেছে। কিন্তু পুলিশ তাকে চিকিৎসা না দিয়ে হাজতে রাখে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে আবদুর রহমান সবার বড়। তিনি সোনাপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ কারণে ২০০৮ সালের পর আর বাড়িতে থাকতে পারেননি। আড়াই বছর আগে রিয়া আক্তার নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। তাদের রাইকা নামে আট মাস বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। আবদুর রহমান আমিশাপাড়া খলিলুর রহমান আলীয়া মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করলেও ছাত্রদল করার কারণে ২০১৩ সালে তাকে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি।
আবদুর রহমানের বোন সালমা আক্তার বলেন, আমার দুই ভাই আবদুল কাইয়ুম আকরাম দুবাই এবং ওমর ফারুক সৌদি আরবে থাকেন। বড় ভাই আবদুর রহমানও আমেরিকা যাওয়ার জন্য ৪৫ লাখ টাকা কন্ট্রাক্ট করে সাত লাখ টাকাসহ পাসপোর্ট জামা দিয়ে রেখেছেন। আমার বাবা মাওলানা সাইদুল হক ও মা রোকেয়া বেগমের দেখাশোনা করতেন এই ভাই। তারা আমার নিরপরাধ ভাইকে মেরে ফেলেছে। আমি এর বিচার চাই।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার ভোরে সোনাপুর ইউনিয়নের হীরাপুর গ্রামের হাওলাদার বাড়িতে অভিযান চালায় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী। তারা আবদুর রহমান ও প্রতিবেশী ভাতিজা যুবদল কর্মী হাবিবুর রহমানকে আটক করে বেদম মারধর করে। পরে তাদেরকে পানিতে নামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর দোকানের সামনে নিয়েও মারধর করে।
নোয়াখালী সেনা ক্যাম্পের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রিফাত আনোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ভোরে দুই আসামিকে দুটি গুলি ও তিনটি ছুরিসহ আটক করে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সোনাইমুড়ী থানায় সোপর্দ করা হয়। পরে পুলিশ মামলা রুজু করে আদালতে উপস্থাপন করে। সন্ধ্যায় হাসপাতালে আবদুর রহমান মারা যান।
তিনি দাবি করেন, কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের প্রশ্নই আসে না। ধরার সময় ধস্তাধস্তিতে সামান্য আহত হতে পারে। তবে সারাদিন তিনি থানা হেফাজতে ছিলেন। তেমন কিছু হলে চিকিৎসার প্রয়োজন হতো। বিকেলে আদালতে সোপর্দ করা হলে আবদুর রহমান অসুস্থ বোধ করেন। পরে তাকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার মৃত্যু হয়। বিষয়টি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তদন্ত চলছে। পরে বিস্তারিত জানানো হবে।
নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক মো. আবদুল মান্নান শাকিল জাগো নিউজকে বলেন, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে পুলিশ আবদুর রহমানকে অসুস্থ অবস্থায় জরুরি বিভাগে নিয়ে আসে। তার গায়ে মারধরের চিহ্ন রয়েছে। আবদুর রহমানকে ভর্তির কিছুক্ষণ পর ওয়ার্ডে নেওয়া হলে তার মৃত্যু হয়। বাকি আহত হাবিবুর রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
নোয়াখালী আদালতের পরিদর্শক (কোর্ট ইন্সপেক্টর) মো. শহীদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সোনাইমুড়ি থানার অস্ত্র আইনের মামলায় দুই আসামিকে হাজির করলে তাদের শারীরিক অসুস্থতা দেখে চিকিৎসার নির্দেশ দেন বিচারক। পরে তাদের পুলিশি পাহারায় হাসপাতালে পাঠানো হয়। শুনেছি সেখানে আবদুর রহমান নামে একজন মারা গেছেন।
সোনাইমুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোরশেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের কাছে আসামিদের সোপর্দ করার পর সকালে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে ডাক্তার দেখার পর আবার থানায় আনা হয়। বেশি অসুস্থ থাকলে ডাক্তার অন্যত্র পাঠাতেন। আমরা আসামি বুঝে পাওয়ার পর থেকে সিসিটিভি ফুটেজ আছে। বিকেলে উপ-পরিদর্শক (এসআই) কাওছারুজ্জামানের দায়ের করা অস্ত্র মামলায় তাদেরকে আদালতে পাঠালে সেখানে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ওসি আরও বলেন, আবদুর রহমান সোনাপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার মরদেহের সুরতহাল তৈরি ও ময়নাতদন্তের কাজ চলছে। প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা যুবদলের সভাপতি মঞ্জুরুল আজিম সুমন জাগো নিউজকে বলেন, খবর পেয়ে রাতে হাসপাতালে গিয়ে আবদুর রহমানের মরদেহ দেখতে পাই। তিনি আমাদের দলের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। আগামী কাউন্সিলে আবদুর রহমান ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন। তার এমন মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের বিচার দাবি করছি।
ইকবাল হোসেন মজনু/এফএ/জিকেএস