নদীভাঙনে পুনর্বাসন সহযোগিতা

জনপ্রতি বরাদ্দ ৭৫ হাজার, ২৫-৬০ হাজারই চেয়ারম্যানদের পকেটে!

জুয়েল সাহা বিকাশ
জুয়েল সাহা বিকাশ জুয়েল সাহা বিকাশ , জেলা প্রতিনিধি, ভোলা ভোলা
প্রকাশিত: ০৫:২০ পিএম, ০৫ জানুয়ারি ২০২৫
ভোলায় নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এক দম্পতি/ছবি-জাগো নিউজ

ভোলায় নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্রদের পুনর্বাসনের আর্থিক সহযোগিতার টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। তালিকায় নাম থাকা হতদরিদ্র ক্ষতিগ্রস্তদের তিন ক্যাটাগরিতে ৫০-৭৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হলেও তারা বেশিরভাগই হাতে পেয়েছেন ১০ হাজার টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্রদের তালিকায় নাম রয়েছে উপজেলা ও ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাসহ ইউপি মেম্বারদের।

ঘটনাটি ঘটেছে ভোলার মনপুরা উপজেলায়। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, তাদের নামে সরকারি টাকা লুটপাট করেছেন উপজেলার চার ইউপি চেয়ারম্যান। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ রয়েছে।

মনপুরা উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের প্রকল্প কর্মকর্তা অফিস সূত্রে জানা গেছে, মনপুরা উপজেলার হাজিরহাট, মনপুরা, উত্তর সাকুচিয়ার ও দক্ষিণ সাকুচিয়ার ইউনিয়নের নদীভাঙনকবলিত ক্ষতিগ্রস্ত অসচ্ছল হতদরিদ্র ১৫২ জনের পুনর্বাসনের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রী পুনর্বাসন সহায়তার আওতায় এক কোটি প্রায় ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তিন ক্যাটাগরিতে হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে ৫০ হাজার, ৬০ হাজার ও ৭৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে হাজিরহাট ইউনিয়নের ৫১ জন, মনপুরা ইউনিয়নের ৩৫ জন, উত্তর সাকুচিয়ার ৩৩ জন এবং দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের ৩৩ জনের মধ্যে টাকা বিতরণ করা হয়।

জনপ্রতি বরাদ্দ ৭৫ হাজার, ২৫-৬০ হাজারই চেয়ারম্যানদের পকেটে!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তালিকায় নাম থাকা হাজিরহাট ও মনপুরা ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র পরিবার সব প্রক্রিয়া শেষ করে টাকা উত্তোলন করলেও তাদের ভাগ্যে জুটেছে মাত্র ১০ হাজার টাকা করে। উত্তর সাকুচিয়া ও দক্ষিণ সাকুচিয়ানে জুটেছে সর্বোচ্চ ৩০-৪৫ হাজার টাকা করে।

তালিকায় নাম থাকা হাজিরহাট ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বেড়িবাঁধ এলাকার আব্দুর রব জানান, নদীভাঙনের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য টাকা দেওয়া হবে বলে তার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন হাওলাদার ছবি, ভোটার আইডি কার্ডসহ প্রায়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যান। পরে সব কাজ শেষ করে তার নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ সব প্রক্রিয়াই ইউপি চেয়ারম্যানরা দাঁড়িয়ে থেকে শেষ করেন। পরে ২০২২ সালের এপ্রিল ও মে মাসের দিকে ইউপি চেয়ারম্যানরা তাদের মনপুরা উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসে ডেকে আনেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বরাদ্দের চেক বুঝিয়ে পাওয়ার খাতায় সই ও টিপসই রেখে চেক হাতে দিয়ে ছবি তুলে রাখেন। এছাড়া ১০-১২ জনের চেক উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সামনে নিয়েও ছবি তুলে রাখেন। পরে ব্যাংকে ডেকে এনে চেক হাতে তুলে দিয়ে তাদের হাতেই টাকা উত্তোলন করানো হয়। পরে ওই টাকা নিয়ে যান ইউপি চেয়ারম্যানরা। এর কয়েকদিন পরে তাকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে ডাকা হয়। সেখানে গিয়ে দেখেন তার মতো আরও কয়েকজন টাকা নিতে এসেছেন। পরে চেয়ারম্যান তাকেসহ কয়েকজনকে ১০ হাজার টাকা করে হাতে তুলে দেন। আর তিনি ওই টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পাননি বলে দাবি করেন তিনি।

আব্দুর রব বলেন, ‘আমার বসতঘর কয়েক দফা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। টাকার অভাবে জমি কিনতে ও ঘর তুলতে পারছি না। আত্মীয় বাড়িতে একটি বারান্দায় পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। দিনমজুরের কাজ করি। তাই টাকার অভাবে বেড়িবাঁধের পাশে ঘর তোলার মতো টাকাও নেই।’

জনপ্রতি বরাদ্দ ৭৫ হাজার, ২৫-৬০ হাজারই চেয়ারম্যানদের পকেটে!

একই এলাকার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা মো. সাহাবুদ্দিন। তিনি জানান, পুনর্বাসনের সরকারি টাকা দেবে বলে তাদের কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেওয়া হয়। পরে চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে থেকে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা অফিসে নিয়ে সই নেন। তার হাতে চেক তুলে দিয়ে ছবিও তোলেন তারা। ছবি তোলা শেষে চেয়ারম্যান তার হাত থেকে চেক নিয়ে যান। পরে ব্যাংকে নিয়ে তাকে দিয়ে চেক জমা দিয়ে চেয়ারম্যান টাকা তুলে নিয়ে যান এবং পরের দিন তাকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে দেখা করতে বলেন। চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেলে তার হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দেন। ওইসময় তিনি ৭৫ হাজার টাকা দাবি করলেও তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ১০ হাজার টাকাই তার নামে এসেছে।

একই অভিযোগ করেন দক্ষিণ সাকুচিয়ার ইউনিয়নের নতুন স্লইস সংলগ্ন বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা রফিজল ইসলাম। তিনি জানান, তার কাছ থেকেও একইভাবে কাগজপত্র ও ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে তাদের চেয়ারম্যান অলি উল্লাহ কাজল নিয়ে যান। পরের দিন তাকে চেয়ারম্যানের নিজস্ব অফিসে ডেকে ৪৫ হাজার টাকা তুলে দেন।

রফিজল ইসলাম বলেন, ‘লেখাপড়া জানি না। তাই কাগজে কী খেলা ছিল তা জানতাম না। কয়েকদিন পরে টাকা পাওয়া কয়েকজনের কাছ থেকে শুনেছি তাদের নামে ৭৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ এসেছে। এরপর তারা চেয়ারম্যানের কাছে গেলে চেয়ারম্যান তাদের অফিস খরচসহ অন্যান্য খরচ দেখিয়ে যা পেয়েছেন তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বলেন।

জনপ্রতি বরাদ্দ ৭৫ হাজার, ২৫-৬০ হাজারই চেয়ারম্যানদের পকেটে!

ভুক্তভোগী মিনু কাজী জানান, টাকার অভাবে তিনি ঘর তুলতে পারছেন না। নদীভাঙনের পরে বেড়িবাঁধের পাশে কোনো রকম একটি ঘর তুলে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছেন। কিন্তু নদীভাঙনের পুনর্বাসনের জন্য তার নামে সরকারিভাবে যে টাকা এসেছে, তার পুরোটা তিনি পাননি। তাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাকে ৪৫ হাজার টাকা দিয়েছেন।

একই এলাকার ভুক্তভোগী হতদরিদ্র কহিনুর বেগম। তিনিও জানান, চেয়ারম্যানরা তাদের টাকা ৩০ হাজার টাকা কম দিয়েছেন।

মনপুরা ইউনিয়নের তুলাতুলি গ্রামের বাসিন্দা সোহাগ জানান, তিনি মাত্র ১০ হাজার টাকা হাতে পেয়েছেন। মনপুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমানউল্যাহ আলমগীরের ভাই মো. সাহাবুদ্দিন তাকে ১০ হাজার টাকা তুলে দেন।

সাকুচিয়ার ইউনিয়নের নতুন স্লইস এলাকার বেড়িবাঁধের বাসিন্দা দিনমজুর কামাল হোসেন বলেন, পুনর্বাসনের তালিকায় নাম আছে বলে তার কাছে ৩০ হাজার টাকা ঘুস দাবি করা হয়। পরে তিনি স্থানীয়দের কাছ থেকে সুদের ওপর ধার নিয়ে চার হাজার টাকা দিয়েছেন। কিন্তু পরে জানতে পারেন টাকা দেওয়ার তালিকায় তার নাম নেই। এজন্য তিনি আর টাকা পাননি।

মনপুরা ইউনিয়নের সীতাকুণ্ড গ্রামের পুষ্পিতা রানী ও হাজিরহাট ইউনিয়নের হাজিরহাট বাজার সংলগ্ন বেড়িবাঁধের বাসিন্দা নারর্গিজ বেগম, দুলাল ও হেলাল বলেন, তারা প্রকৃত নদীভাঙনের শিকার। কিন্তু নদীভাঙনের পুনর্বাসনের আর্থিক সহযোগিতার তালিকার তাদের নাম নেই। অথচ বড়লোক আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারদের নাম ওই তালিকায় আছে। কিন্তু আমাদের মতো গরিব ও অসহায়দের নাম নেই।

অসচ্ছল না হয়েও পুনর্বাসনের টাকা পাওয়া মনপুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মনপুরা ইউপি প্যানেল চেয়ারম্যান রুহুল আমিন এবং মনপুরা ইউনিয়নের যুবলীগের সাংগঠনের সম্পাদক জুয়েল চন্দ্র দাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তাদের পাকা বাড়ি রয়েছে। রয়েছে অনেক জমিজমা। এ বিষয়ে রুহুল আমিনের স্ত্রী জোসনা বেগম ও জুয়েল চন্দ্র দাসের মা পুষ্প রানীর কাছে জানতে চাইল তারা বিষয়টি এড়িয়ে যান।

jagonews24

তাদের বাড়ি কখনো নদীতে ভেঙেছে কিনা এমন প্রশ্নে দাবি করেন, ৫০-৬০ বছর আগে তাদের জমি নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। তাদের কাছে রুহুল আমিন ও জুয়েল চন্দ্র দাসের বিষয়ে জানতে চাইলে জানান, চিকিৎসার জন্য তারা ঢাকায় গেছেন।

এ ঘটনার গা ঢাকা দিয়েছেন হাজিরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নিজাম উদ্দিন হাওলাদার, মনপুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমানউল্যাহ আলমগীর, উত্তর সাকুচিয়ার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন এবং দক্ষিণ সাকুচিয়ার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক অলিউল্যাহ কাজল।

মনপুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমানউল্যাহ আলমগীর পুনর্বাসনের টাকা লুটপাটের কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে জানান, তালিকায় থাকা ১৫২ জনের বরাদ্দের থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইলিয়াস মিয়াকে ১৫ শতাংশ কমিশন দিয়েছেন। তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার জন্য অনেক কৌশল অবলম্বন করেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তালিকার নাম যাচাই-বাছাই করেছেন। তিনি দুর্নীতি করে এখন চেয়ারম্যানদের ফাঁসাচ্ছেন।

jagonews24

কিন্তু চেয়ারম্যানদের অভিযোগ মানতে নারাজ মনপুরা উপজেলার সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইলিয়াস মিয়া। তিনি বলেন, তালিকা করা, যাচাই-বাছাই সবই ইউপি চেয়ারম্যানরা করেছেন। তারাই তালিকায় তাদের সচ্ছল দলীয় নেতা ও ইউপি মেম্বারদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি কোনো অনিয়ম করেননি ও কমিশন নেননি।

এ বিষয়ে মনপুরা উপজেলার বর্তমান প্রকল্প কর্মকর্তা ফজলুল হক জানান, তিনি এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাননি। তবে এখানে যোগযোগের পর জানতে পেরেছেন, নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য আর্থিক সহযোগিতা বিতরণ করা হয়েছে। অনিয়মের বিষয়ে ভুক্তভোগী কেউ লিখিত অভিযোগ করলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থ নেওয়া হবে।

মনপুরা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা পাঠান মো. সাইদুজ্জামান বলেন, পুনর্বাসনের টাকা বিতরণের অনিয়মের বিষয়টি জেলা প্রশাসকে জানানো হবে।

এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।