ময়মনসিংহ

১৯-৩৫ বছর বয়সীদের এইডস আক্রান্তের হার বেশি, বেশিরভাগই সমকামী

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ময়মনসিংহ
প্রকাশিত: ০৪:২১ পিএম, ০২ জানুয়ারি ২০২৫
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এইচআইভি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণ এক তরুণ

ময়মনসিংহ নগরীর আনন্দ মোহন কলেজের অনার্সের ছাত্র জাহিদ (ছদ্মনাম)। তিনি কয়েকজন ছেলের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ান। একপর্যায়ে তার শরীরে অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দেয়। কোনোভাবেই চুলকানি ভালো হচ্ছিল না। পাঁচ মাস আগে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসককে দেখান। সেখানে পরীক্ষায় ধরা পড়ে তিনি এইডসে আক্রান্ত।

জেলার ভালুকার শিক্ষার্থী ফাহিম (ছদ্মনাম)। তিনিও সমকামী। তিনিও চুলকানিজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। ময়মনসিংহ মেডিকেলে বিনামূল্যে এইডস পরীক্ষা করাতে সম্প্রতি হাসপাতালে আসেন। এসময় তারও এইডস ধরা পড়ে। এছাড়া চলতি বছরের মে মাসে ময়মনসিংহের একটি উপজেলার এক পরিবারের স্বামী, স্ত্রী ও তাদের তিন শিশু সন্তানের এইডস শনাক্ত হয়। গৃহকর্তার মাধ্যমে এটি অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯-৩৫ বছর বয়সীদের এইডস আক্রান্তের হার বেশি, বেশিরভাগই সমকামী

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে এইডস রোগীর সংখ্যা। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই সমকামী তরুণ। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই তরুণদের মধ্যে এইডস আক্রান্তের হার বাড়ছে। ফলে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এইচআইভি টেস্টিং সার্ভিস (এইচটিসি) সেন্টার সূত্র জানায়, প্রায় পাঁচ বছরে ১১ হাজার ২০৮ জনের এইচআইভি পরীক্ষা করে ৬০ জনের শরীরে এইডস ধরা পড়েছে। এরমধ্যে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিন হাজার ৩৯২ জনের পরীক্ষা করে দুজনের শরীরে এইডস শনাক্ত হয়। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার ৭২৯ জনের পরীক্ষা করে ১০ জনের শরীরে এইডস শনাক্ত হয়। আর ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনহাজার ২৯৬ জনের পরীক্ষা করে এইডস ধরা পড়ে ১৪ জনের। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ৭৯১ জনের এইচআইভি পরীক্ষা করে ৩৪ জনের এইডস শনাক্ত হয়। গত দুই বছরের ব্যবধানে এইডসে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আর আক্রান্ত ৫৮ জনের মধ্যে ৫৩ জনই পুরুষ। এরমধ্যে সমকামী ৪০ জন।

বুধবার (১ জানুয়ারি) সকালে হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, এক তরুণ চোখে-মুখে ক্রান্তির ছাপ নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। সঙ্গে আছেন তারই আরেক বন্ধু। তারা জাগো নিউজকে জানান, অনেকদিন ধরে ক্লান্তিভাব ছাড়ছে না। এরমধ্যে জ্বর ও মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। চিকিৎসকের কাছে এলে এইচআইভি পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। তাই পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছেন।

১৯-৩৫ বছর বয়সীদের এইডস আক্রান্তের হার বেশি, বেশিরভাগই সমকামী

হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের দ্বায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি (এইডসের ভাইরাস) পজিটিভ ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এরপর সময় যত যাচ্ছে ময়মনসিংহের এ রোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে। তবে বয়সে তরুণদের মধ্যে এইডসে আক্রান্তদের বেশিরভাগই সমকামী।

ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন কালাম বলেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক। তরুণদের বোঝাতে হবে তারা যেন বিপথে গিয়ে নিজেদের ক্ষতি না করে। সেজন্য তাদের পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও এইডস বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে আলোচনা করতে হবে। সবার প্রচেষ্টায় সচেতন করা গেলে এইডস রোগীর সংখ্যা কমবে।

ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন ও দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা এ সমস্যা অনেকটা রোধ করতে পারে মন্তব্য করেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক মাসুম বিল্লাহ।

তিনি বলেন, একটি সন্তান একটি পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তরুণরা বিপথগামী হলে তাদের পরিবারের মতো আমাদেরও কষ্ট লাগে। এইডসের ভয়াবহতা সম্পর্কে সবার জানতে হবে। এজন্য বেশি করে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।

হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের কাউন্সিলর কাম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আবদুল আল মামুন বলেন, অরক্ষিত যৌনমিলন, রক্ত, বীর্য, বুকের দুধ আদান-প্রদান, অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, অপরীক্ষিত রক্ত গ্রহণ, একই সুই-সিরিঞ্জ ব্যবহার করে মাদক সেবনেও ছড়াতে পারে এইচআইভি সংক্রমণ। এইচআইভিতে আক্রান্ত মা-বাবার কাছ থেকেও শিশুর শরীরে এইডসের জীবাণু যেতে পারে।

তিনি আরও জানান, ময়মনসিংহে এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই সমকামী পুরুষ। তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৯-৩৫ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে আবার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি।

আবদুল আল মামুন বলেন, আমাদের পরিসংখ্যানের বাইরেও অনেক রোগী থাকতে পারে। তারা পরীক্ষা না করানোয় আরও কী পরিমাণ আক্রান্ত রয়েছেন, তা বলা সম্ভব না। হাসপাতালে এসব রোগী এলে আমরা কাউন্সেলিং করছি।

১৯-৩৫ বছর বয়সীদের এইডস আক্রান্তের হার বেশি, বেশিরভাগই সমকামী

হাসপাতালের এইচআইভি ইউনিটের ফোকাল পারসন ফরহাদ হোসেন হীরা বলেন, এইডসে আক্রান্ত তরুণদের বেশিরভাগই সমকামী। তরুণদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এ ধরনের প্রবণতা বাড়ছে। এ থেকে উত্তরণে সামাজিক সচেতনতা জরুরি। তা না হলে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. জাকিউল ইসলাম বলেন, আক্রান্ত হওয়ার আগেই সচেতন থাকা জরুরি। নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হলেই এইডসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রোধ হবে।

কামরুজ্জামান মিন্টু/এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।