যে কারণে এত দুর্ঘটনা ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে
ওভার স্পিড, ওভারটেকিং, সেইসঙ্গে যত্রতত্র পার্কিং আর পারাপারে রীতিমতো দুর্ঘটনার আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেও মুন্সিগঞ্জ অংশে ঝরেছে ৮ প্রাণ। দুমড়ে-মুচড়ে গেছে অন্তত ২০টি যানবাহন। এসব দুর্ঘটনায় যাত্রীরা দুষছেন বেপরোয়া চালকদের। জোরালো আইন প্রয়োগের দাবি জানিয়েছেন তারা।
তথ্যমতে, ২০২০ সালে চালু হয় ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক। দ্রুতগতিতে যান চলাচলের জন্য দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে এটি। এরমধ্যে আলোচিত অংশ ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া পর্যন্ত ঢাকা-মাওয়া অংশ চালু হয় প্রথমে। চার লেনের মূল এক্সপ্রেসওয়ের পাশে আরও চার লেনের সার্ভিস সড়ক। এছাড়াও ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ইন্টারচেঞ্জ, ওভারব্রিজসহ নানান সুবিধা। তবে এরমধ্যেই প্রতিদিন ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।
হাইওয়ে পুলিশের হিসাব মতে, ২০২৪ সালে মুন্সিগঞ্জ অংশে মোট ৪৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক ও আহত শতাধিক। সর্বশেষ গত ২৭ ডিসেম্বর ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় অপেক্ষমাণ মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারসহ কয়েকটি গাড়ি চাপা দেয় বেপারী পরিবহনের একটি বাস। এতে প্রাণ যায় একই পরিবারের চারজনসহ ছয়জনের।
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৬৪। সরকারি আরেকটি হিসাবে এ সড়ক নির্মাণের পর এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১৩৮ জন। প্রতিনিয়ত এমন দুর্ঘটনায় শঙ্কিত যাত্রীরা। বেপরোয়া গাড়ি চালানোসহ নানান অভিযোগ তাদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, নিষেধাজ্ঞা থাকলেও দেখা যায় যত্রতত্র পারাপার, পার্কিং, যাত্রী ওঠানামাসহ ট্রাফিক আইন অমান্যের হিড়িক। মূল এক্সপ্রেসওয়েতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার ও পাশের সার্ভিস সড়কে ৪০ কিলোমিটার গতিতে যান চালানোর নির্দেশনা রয়েছে। তবে নির্ধারিত গতি উপেক্ষা করছে অধিকাংশ যানবাহন। মহাসড়কে টহলরত হাইওয়ে পুলিশের স্পিডগানে দেখা যায়, কোনোটি ১০০, কোনোটি ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলছে। মোটরসাইকেল আরও বেশি বেপরোয়া।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মহসিন জানান, প্রায় দুর্ঘটনার পর দেখা যায় গাড়ির ফিটনেস নেই, চালকের লাইসেন্স নেই। এগুলো তো আগে দেখার কথা। এগুলো আগে দেখা হলে সচেতনতা বৃদ্ধি পেতো, দুর্ঘটনাও ঘটতো না।
স্থানীয় আলমাস হোসেন নামে একজন বলেন, দিনরাত যে যার মতো গাড়ি চালাচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি থামার কথা নয়। কিন্তু যেখানে সেখানে গাড়ি থেমে যায়। পেছন থেকে আরেকটি গাড়ি মেরে দেয়। চার-পাঁচটা গাড়ি একসঙ্গে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
চালকদের অজুহাত
সম্প্রতি কুয়াশায় দুর্ঘটনা বেড়েছে বলে দাবি গাড়িচালকদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইলিশ পরিবহনের এক বাসচালক বলেন, কুয়াশার মধ্যে পথ দেখা যায় না। হঠাৎ একটা গাড়ি থামিয়ে রাখলে দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের করার কিছু থাকে না। আমরা তো ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটাই না।
হুমায়ন আহমেদ নামে আরেক বাসচালক বলেন, মূলত বেশি দুর্ঘটনা ঘটে যারা এ রোডে নতুন আসে তাদের জন্য। অনেকে ঘুরতে এসে বেপরোয়া গাড়ি চালায়। তাদের বাঁচাতে গিয়ে আমরা দুর্ঘটনায় পড়ি।
এদিকে যে কোনো দুর্ঘটনার পর উদ্ধার কাজে আসে ফায়ার সার্ভিস। তাদের দাবি, গতির জন্যই অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে।
মুন্সিগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা যখন রেসকিউ করতে যাই তখন দেখি গাড়িগুলো একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। অনেক সময় যন্ত্রের মাধ্যমে কেটে হতাহতদের বের করতে হয়। গতির কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটে। আমি মনে করি, ঘন কুয়াশায় নিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চালাতে হবে। সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
মামলা দিয়েও যাচ্ছে না সামলানো
হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছর মুন্সিগঞ্জ অংশে শৃঙ্খলাভঙ্গে সড়ক পরিবহন আইনে করা হয়েছে ২ হাজার ৪৬৯টি মামলা। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ১৪৫টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৩০টি, মার্চে ১২৫, এপ্রিলে ৩৩৮, মে’তে ৩৩০, জুনে ৩৫২, জুলাইয়ে ২০৯, সেপ্টেম্বরে ৫৫, অক্টোবরে ২১৫, নভেম্বরে ১৫৮ এবং ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত ৪১১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে আগস্ট মাসে নথি হারিয়ে যাওয়ায় মামলার তথ্য দিতে পারেনি পুলিশ।
হাসাড়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল কাদের জিলানী বলেন, প্রতি মাসে মামলা দেওয়া হচ্ছে। প্রথম বিবেচনায় অতিরিক্ত গতি, দ্বিতীয়ত ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করি। চালকদের অসচেতনতার পাশাপাশি যাত্রীরাও অনেক সময় বাধ্য করে যানবাহন যেখানে সেখানে থামাতে। আমরা মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করেছি, পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয় করছি দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে। তবে আইনের বাস্তবায়নের জন্য চালক-যাত্রীদের সচেতনতা প্রয়োজন। নির্ধারিত গতি ও শীতে কুয়াশার সময় ফগলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হবে।
এফএ/জিকেএস