সুন্দরবনে ভাসমান হাসপাতালের অপেক্ষায় লক্ষাধিক বনজীবী

আবু হোসাইন সুমন আবু হোসাইন সুমন মোংলা (বাগেরহাট)
প্রকাশিত: ০৮:১২ পিএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪
সুন্দরবনে চিকিৎসা ঝুঁকিতে বনজীবীরা-ছবি জাগো নিউজ

সুন্দরবনে পুরো মৌসুমে জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালসহ বনজীবীর উপস্থিতি লক্ষাধিক। এদের চিকিৎসাসেবা ও জীবন রক্ষায় সুন্দরবন এলাকায় কোনো হাসপাতাল নেই। ২০১০ সালে বনবিভাগ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দুটি ভাসমান হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবনা পাঠালেও আজ পর্যন্ত তার কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে এসব বনজীবী প্রাথমিক সেবা থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। মৎস্যজীবী সমিতির নেতা ও জেলে মহাজনরা দাবি করছেন, সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগে মৌসুমভিত্তিক দুটি ভাসমান হাসপাতাল স্থাপনের।

বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগের আওতাধীন চারটি রেঞ্জ ও সাগর উপকূলে সাধারণত মৌসুমভিত্তিক বনজীবীদের আগমন ঘটে। এর মধ্যে ইলিশ, শুঁটকি, গোলপাতা, মধু ও মোম আহরণ মৌসুম উল্লেখযোগ্য। সুন্দরবন ও সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুঁটকি মৌসুম, এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ইলিশ, মধু ও মোম মৌসুম এবং বছরের অন্য সময় গোলপাতা আহরণ মৌসুম থাকায় বছরজুড়েই জীবিকার টানে ছুটে আসে জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালসহ নানা পেশার লোকজন। এ সময় বিশুদ্ধ পানি ও সুচিকিৎসার অভাবে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাছাড়া বাঘ, কুমির, বিষধর সাপসহ বিভিন্ন হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ হয় প্রতিনিয়ত।

সুন্দরবনে ভাসমান হাসপাতালের অপেক্ষায় লক্ষাধিক বনজীবী

সুন্দরের মধ্যে যাদের জীবিকা তাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ-ছবি জাগো নিউজ

আরও পড়ুন

মোংলা থেকে নদী পথে দুবলা জেলে পল্লির দূরত্ব প্রায় ৯০ নটিক্যাল মাইল। প্রত্যন্ত এ স্থান থেকে এসব আহত বনজীবীকে গহিন বন থেকে ট্রলারে হাসপাতালে নিতে প্রায় ১৫ ঘণ্টা সময় দরকার। যে কারণে অনেক সময় চিকিৎসার অভাবে বনজীবীদের পথে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে।

সুন্দরবন ও সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুঁটকি মৌসুম, এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ইলিশ, মধু ও মোম মৌসুম এবং বছরের অন্য সময় গোলপাতা আহরণ মৌসুম থাকায় বছরজুড়েই জীবিকার টানে ছুটে আসে জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালসহ নানান পেশার লোকজন। এ সময় বিশুদ্ধ পানি ও সুচিকিৎসার অভাবে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাছাড়া বাঘ, কুমির, বিষধর সাপসহ বিভিন্ন হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ হয় প্রতিনিয়ত।

বনবিভাগ সূত্র আরও জানায়, এসব অবহেলিত দরিদ্র শ্রেণির কথা চিন্তা করে ১৯৯৩ সালে আন্তঃমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত এক বৈঠকে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় তিনটি মিনি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণের কথা বলা হয়। কিন্তু সেটা শুধু আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ থাকে। এরপর দীর্ঘ ১৭ বছরেও এ নিয়ে বনবিভাগ বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পরিকল্পনা বা প্রস্তাবনা আসেনি। এরপর ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বন বিভাগ সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগে দুটি ভাসমান হাসপাতাল নির্মাণের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রেরণ করে। কিন্তু ১৪ বছর পার হওয়ার পরও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতির খবর জানাতে পারেনি বন বিভাগ।

আরও পড়ুন

সুন্দরবনের জেলে মঠবাড়িয়ার সেলিম পাটোয়ারী, পাইকগাছার আলমগীর হোসেন, মোংলার নজরুল ইসলামসহ একাধিক জেলে জানান, দুবলার মেহের আলীর চর, আলোর কোল, অফিস কিল্লা, মাঝের কিল্লা, শেলার চর, নারকেল বাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, বড় আমবাড়িয়া, মানিকখালী, কবরখালী, ছাপড়াখালীর চর, কোকিলমনি ও হলদেখালী চরে মাত্র ৫-৬টি ফার্মেসি। কোনো চিকিৎসক নেই। জ্বর বা ডায়রিয়ার ওষুধ ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ সচরাচর মেলে না। ফলে কেউ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে অথবা হাত-পা কেটে গেলে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকে না।

সুন্দরবনে ভাসমান হাসপাতালের অপেক্ষায় লক্ষাধিক বনজীবী

বনজীবীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ-ছবি জাগো নিউজ

সুন্দরবন উপকূলের মৎস্যজীবী ও মালিক সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, পুরো বছর ইলিশ মৌসুম, শুঁটকি মৌসুম, গোলপাতা মৌসুমসহ বিভিন্ন সময় লক্ষাধিক বনজীবী সুন্দরবনে আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, তাদের চিকিৎসার জন্য সরকার বা বনবিভাগের কোনো ব্যবস্থা নেই। বহু আগে শুনেছিলাম হাসপাতাল হবে। কিন্তু তা যে কবে হবে কেউ তা বলতে পারে না।

দুবলার মেহের আলীর চর, আলোর কোল, অফিস কিল্লা, মাঝের কিল্লা, শেলার চর, নারকেল বাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, বড় আমবাড়িয়া, মানিকখালী, কবরখালী, ছাপড়াখালীর চর, কোকিলমনি ও হলদেখালী চরে মাত্র ৫-৬টি ফার্মেসি। কোনো চিকিৎসক নেই। জ্বর বা ডায়রিয়ার ওষুধ ছাড়া অন্য কোনো ওষুধও সচরাচর মেলে না। ফলে কেউ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে অথবা হাত-পা কেটে গেলে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকে না।

দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্বখ্যাত সুন্দরবনের বার্ষিক রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে এই অবহেলিত বনজীবীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। যার কারণে তাদের স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা প্রদান করা সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি বা আদৌ হবে কি না সংশ্লিষ্টরা সে বিষয়ে সন্তোষজনক কিছু বলতে পারছে না।

সুন্দরবনে ভাসমান হাসপাতালের অপেক্ষায় লক্ষাধিক বনজীবী

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন-ছবি জাগো নিউজ

আরও পড়ুন

এছাড়া সুন্দরবন রক্ষায় কর্মরত বনরক্ষীদের চিকিৎসার জন্যও একই রকম সমস্যা দেখা যায়। করমজল বন্যপ্রাণী ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, চিকিৎসার জন্য বনরক্ষীদের লোকালয় অথবা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হয়। নৌকা বা ট্রলার ছাড়া যাতায়াতের অন্য কোনো মাধ্যম না থাকায় নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বনের অনেক দূরবর্তী ও দুর্গম স্থান রয়েছে যেখান থেকে ট্রলারে বা নৌকায় লোকালয়ে আসতে ১৪-১৫ ঘণ্টা সময় লাগে। সুন্দরবনে যদি রেসকিউ বোট থাকতো তাহলে সবার জন্য খুবই উপকার হতো। একই সাথে ভাসমান হাসপাতাল হলে আমরাও খুবই উপকৃত হতাম।

এ ব্যাপারে সুন্দরবনের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, শুধু বনজীবী নয় সুন্দরবনের দুর্গম এলাকায় যে সব বনরক্ষী কাজ করেন তাদের চিকিৎসা সেবায়ও হাসপাতালের খুব প্রয়োজন। গত দুই বছর আগে সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবেন পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগে দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কাজ করছেন। যদিও সেটি কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। বনজীবী ও বনকর্মীদের সংখ্যার তুলনায় এটা খুবই অপ্রতুল। স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিবেচনা করবে। তারপরও আমরা আশা করবো সুন্দরবনের পূর্ব এবং পশ্চিম বিভাগের জন্য মৌসুমভিত্তিক দুটি ভাসমান হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হোক।

আবু হোসাইন সুমন/এসএইচএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।