যশোরে আ’লীগ নেতা খুন
২১ বছরে মেলেনি বাবা হত্যার বিচার, ছেলে হত্যায় মিলবে কি?
একতলা ভবনের সামনে শতাধিক নারী-পুরুষের জটলা। বাড়িতে পাঁচটি কক্ষ। একটি কক্ষে বিলাপ করছেন বৃদ্ধা ফরিদা বেগম। ছেলের শোকে তিনি বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন। তাকে ঘিরে আছেন কয়েকজন নারী। তারা তাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাঝে মধ্যে তিনি বলে উঠছেন, ‘আমরা সহজ সরল জীবনযাপন করি। আমরা মানুষের কোনো ক্ষতি করি না। চাঁদার জন্য আমার ছেলেডারে মেরে ফেললো। ছেলেডার তার বাবার মতো একই পরিণতি হলো।’
একুশ বছর আগে দুবৃর্ত্তদের হাতে স্বামী ইব্রাহিমকে হারান ফরিদা। এতোদিন ছেলে জিয়াউদ্দিন পলাশকে আঁকড়ে বেঁচে ছিলেন তিনি। স্বামীর মতো ছেলের একই পরিণত হওয়ায় শোকের সাগরে ভাসছেন তিনি।
শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে পলাশকে নওয়াপাড়া নৌবন্দর এলাকায় একটি পরিত্যক্ত ভবনের নিচতলায় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ফেলে রেখে যায় দুবৃর্ত্তরা। পলাশ নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও একই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর।
পুলিশ ও স্বজনরা বলছেন, নৌ বন্দরের ঘাট নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় এলাকার লোকজন রইচ সিকদার (৩৫) নামের ওয়ার্ড বিএনপির এক নেতাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রইচ একই ওয়ার্ডের রেলবস্তির সিদ্দিক শিকদারের ছেলে। তিনি নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির প্রচার সম্পাদক। এছাড়া তিনি নওয়াপাড়া পৌর যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় দুই দশক আগে নিহত পলাশের বাবা ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও শ্রমিক নেতা ইব্রাহিম হাসান সরদার ঘাট নিয়ে পূর্ব বিরোধে দুর্বৃত্তদের গুলিতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বাবার মতো ছেলেরও একই পরিণতি হওয়ায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রোববার যশোর জেনারেল হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যায় পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
রোববার বিকেলে পলাশের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একতলা আধা সমাপ্ত বাড়িতে স্বজন ও এলাকাবাসীর আহাজারি। একটি গাছতলায় নিহত পলাশের ছোট ভাই আব্দুল মান্নান লেলিন কাঁদছেন। তাকে ঘিরে স্বজনেরা সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বাড়ির ভেতরে একটি কক্ষে আধশোয়া অবস্থায় পলাশের স্ত্রী শারমিন নাহার রত্না (৩৫)। তাকে ঘিরে আছে তার দুই ছেলে তাসিন সরদার (১০) ও তাইফ সরদার (৯ মাস)। তাদের ঘিরে আছেন কয়েকজন নারী। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শারমিন নাহার। মাঝে মধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠছেন।
তিনি বলছিলেন, ‘আমার সন্তানদের এখন কে দেখবে। তারা কাকে বাবা বাবা বলে ডাকবে। আমার সন্তানের পিতা হত্যার বিচার চাই।’
নিহতের ছোট ভাই আব্দুল মান্নান লেলিন বলেন, ২০০৩ সালের ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা নওয়াপাড়া রেলস্টেশন এলাকায় বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। তৎকালীন নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন তিনি। বাবা হত্যার বিচার আজও মেলেনি। এবার এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী রইচ উদ্দিন তার সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে বড় ভাই পলাশকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। প্রথমে অপহরণ, তারপর টাকা নিয়ে ভাইকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে মরদেহ গুম করার উদ্দেশ্যে পরিত্যক্ত ঘরের ভেতর ফেলে রাখা হয়। বাবা হত্যার বিচার মেলেনি, ভাই হত্যার বিচার মিলবে কি? এমন প্রশ্ন করে কাঁদতে থাকেন তিনি।
পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পলাশ বাড়ির কাছে তেঁতুলতলা মসজিদের পাশে একটি চায়ের দোকানে বসে চা পান করছিলেন। এ সময় রইচ সিকদারের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জন চায়ের দোকান থেকে পলাশকে ধরে নিয়ে যান। সন্ধ্যা সাতটা ৪০ মিনিটের দিকে দুই ব্যক্তি পলাশের বাড়িতে যান। তাদের একজন নিজেকে জিহাদ এবং অপরজন সাগর নামে পরিচয় দেয়। তারা শারমিন নাহার রত্নার সঙ্গে তাদের একজনের মুঠোফোনে জিয়াউদ্দিন পলাশের কথা বলিয়ে দেন।
পলাশ তার স্ত্রীকে জানান, তিনি মার্ডার হওয়ার অবস্থায় আছেন। তিনি ওই দুই ব্যক্তিকে ২০ হাজার টাকা দিতে বলেন। তারা টাকা নিয়ে চলে যাওয়ার পর জিয়াউদ্দিন পলাশকে নওয়াপাড়া বুড়িরঘাট এলাকায় আয়কর অফিসের পেছনে ভৈরব নদের তীরে বালুর স্তূপের ওপর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তারা তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে ফেলে রেখে যায়। এলাকার লোকজন তাকে খুঁজে পেয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করে রাত ১০টা ১৫ মিনিটের দিকে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। এসময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনায় রোববার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এমাদুল করিম।
মামলা প্রক্রিয়াধীন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নিহত পলাশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নওয়াপাড়া নৌ বন্দরের একটি ঘাট নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে রইচ সিকদার নামে স্থানীয় বিএনপি কর্মীর সঙ্গে পূর্ববিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জেরে রইচ রাতে পলাশকে তুলে এনে আয়কর অফিসের পেছনে একটি পরিত্যক্ত ভবনে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে ফেলে যান। পরে রইচকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয়রা। এই ঘটনায় রইচকে আটক দেখিয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত চলছে।
মিলন রহমান/এফএ/জিকেএস