খুলনা
রাস্তা সংস্কারে অনিয়ম, তিন মাসের কাজ দুই বছরেও শেষ হয়নি
খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের দেয়াড়া থেকে বাগালী ইউনিয়নের হোগলা অভিমুখী রাস্তা সংস্কার চলছে। কাজটি সাড়ে তিন মাসের মধ্যে শেষ করার কথা। কিন্তু দুই বছর অতিবাহিত চললেও এর কাজ শেষ হয়নি। এখনো অর্ধেক কাজ বাকি। উল্টো নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে রাতের আধারে পিচ ঢালাইয়ের কাজ করছে ঠিকাদারের লোকজন। এমনকি কয়রা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরবর্তী আঠারো মাইল থেকে ঠান্ডা মিক্সচার (পিচ ও পাথর) এনে কাজ করায় এর স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে বার বার প্রশাসনকে জানিয়েও মেলেনি সুফল।
এলাকাবাসী জানান, কয়েক মাস কাজ বন্ধ রাখার পর ১৭ ডিসেম্বর বিকেলে কার্পেটিংয়ের কাজ শুরু হয়। আঠারো মাইল থেকে পিচের মিশ্রণ আনা হয়। এতে ঠান্ডা হয়ে যায় মিশ্রণ। স্থানীয় কয়েকজন ফের গরম করে মিশ্রণ ব্যবহারের কথা বললেও কর্ণপাত করেনি। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর স্থানীয় চেয়ারম্যান, সংবাদকর্মী, আইনজীবী ও বাসিন্দারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উপজেলা প্রকৌশলী দারুল হুদা ও নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাসকে বিষয়টি জানান।
এসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত এলজিইডি অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আফজাল হোসেন গুণগতমান ঠিক না থাকায় ঠিকাদারের লোকজনকে কাজ করতে নিষেধ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পুনরায় কাজ করার চেষ্টা করলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকৌশলী কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। তারপরও কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ঠিকাদারের আস্থাভাজন কিছু ব্যক্তি এসে পুনরায় ঠান্ডা পিচের মিশ্রণ দিয়ে কাজ শুরু করেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল মান্নান জানান, ঠান্ডা মিশ্রণ দিয়ে ঢালাইয়ের বিষয়ে তিনি উপসহকারী প্রকৌশলীকে জানালে প্রথমে ব্যবস্থা নেননি। পরে চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন। পরবর্তীতে কাজ বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে উনি (উপসহকারী প্রকৌশলী) চলে যান। তবে ঠিকাদারের লোকজন ব্যবহার অনুপযুক্ত সেই মিশ্রণ দিয়ে কার্পেটিংয়ের কাজ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা এড. ইয়াসিন বিন সদর বলেন, আমার বাড়ির পাশে রাতে কাজ করতে দেখে সেখানে যাই। ঠান্ডা মিশ্রণ দিয়ে কার্পেটিং করা হয়। এছাড়া যথাযথ বিটুমিন না দিয়ে সড়কের ওপরে নামমাত্র বিটুমিন ছিটিয়ে দেওয়া হয়। আমরা নিষেধ করলেও কর্ণপাত করেনি ঠিকাদারের লোকজন।
স্থানীয় বাসিন্দা আফাজ পাড়, তৈয়েবুর রহমান, মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন জানান, দীর্ঘদিন সড়কটির বিভিন্ন স্থান খুঁড়ে ফেলে রাখায় চলাচলে সমস্যা হয়। সড়ক সংস্কারে অতি নিম্নমানের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে। সেই খোয়া পরিবর্তন না করেই পিচ ঢালাই দেওয়া হচ্ছে। ঢালাই দেওয়া বেশ কিছু অংশ এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। রাস্তার দুই পাশে ঠিকমতো মাটি দেওয়া হয়নি। রাস্তাটির পাশের হেজিংয়ে নিম্নমানের ইট দেওয়া হয়।
কয়রা উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রামীণ সড়ক মেরামত ও সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় উপজেলার আরএন্ডএইচ দেয়াড়া থেকে হোগলার হাট জিসি ও গড়ইখালী জিসির ৪০০ মিটার রাস্তা সংস্কার কাজের টেন্ডার পায় মেসার্স রওশনারা এন্টারপ্রাইজ নামে খুলনার এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০২২ সালে ১৬ অক্টোবর ওই প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার শর্তে নোটিস অব প্রসিউড দেওয়া হয়। কাজটির প্রাক্কালিত মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১ কোটি ৮৫ লাখ ৭ হাজার ৯২৫ টাকা। ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর কাজটি শুরু ও ২০২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কাজটি সমাপ্তির নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রওশনারা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, খুলনা জেলা ছাত্রদলের নেতা রুবেল আমার ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার করে কাজটি করছেন। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনি উপজেলা এলজিইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবেন।
সাব কন্ট্রাক্টর ও কাজের তদারককারী রুবেল বলেন, কিছু সমস্যার কারণে কাজ দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। দেশের পট পরিবর্তনের পর কাজটি দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। গতকাল কার্পেটিংয়ের সময় মেশিনের ত্রুটির কারণে পিচ দিতে দেরি হয়। কাজ ত্রুটিপূর্ণ হলে সমাধান করে দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে কয়রা উপজেলা প্রকৌশলী মো. দারুল হুদা বলেন, কার্পেটিংয়ে সময় উপ-সহকারী প্রকৌশলী আফজাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। অনুপযুক্ত পিচ দিতে চাইলে তিনি নিষেধ করেন এবং কাজ বন্ধ রাখতে বলে চলে আসেন। পরে ওই ব্যবহার অনুপযুক্ত পিচের মিশ্রণ ফের দেওয়ার কথা এলাকাবাসী জানালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করেছিলাম। আমরা ত্রুটিপূর্ণ কাজ হলে তার বিল আটকিয়ে রাখবো।
এদিকে সাব কন্ট্রাকের বিষয়ে তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন উপজেলা প্রকৌশলী।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, রাতে উপজেলা প্রকৌশলী ও স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে বিষয়টি জানতে পেরে কাজ বন্ধের ব্যবস্থা করেছিলাম। ওই ওয়ার্ডের মেম্বর এবং গ্রাম পুলিশের সহযোগিতায় কাজটি এখন বন্ধ। উপজেলা প্রকৌশলীকে ত্রুটিপূর্ণ কার্পেটিং উঠিয়ে নতুন করে কার্পেটিং করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তরিকুল ইসলাম/জেডএইচ/এএসএম