নামের মিলে ১২ বছর ধরে মামলার ঘানি টানছেন নিরপরাধ স্বপন
আসামি তিনি নন। শুধু নামের মিল। এতেই যেতে হয়েছে কারাগারে। পরে জামিনে মুক্ত হলেও মামলা থেকে রেহাই পাননি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বাসিন্দা স্বপন খান। দীর্ঘ এক যুগ ধরে মামলার বোঝা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে নিঃস্ব পরিবার। ভুক্তভোগীর পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের গাফিলতির কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শরীয়তপুরের জাজিরা পৌরসভার মতিসাগর এলাকার আব্দুল মালেক খানের ছেলে দিনমজুর স্বপন খান। স্বল্প আয়ের উপার্জনে স্ত্রী -পরিজন নিয়ে সুখেই কাটছিল সংসার। তবে সেই সুখ দীর্ঘায়িত হয়নি তার জীবনে। ২০১২ সালের ১৬ মার্চ গুলশান থানার একটি অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় দিন স্বপন খানকে। সেই মামলায় ২৬ দিন কারাভোগ শেষে জামিন মেলে তার। তবে জামিনে মুক্তি পেলেও আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে আজ নিঃস্ব হতদরিদ্র পরিবারটি।
অথচ অনুসন্ধানে জানা যায়, এই মামলায় প্রকৃত আসামি নন স্বপন। আসামি একই উপজেলার পার্শ্ববর্তী হামগাঁও এলাকার স্বপন খান ওরফে সুমন। মামলার ভুল তদন্তে আজ আসামি তিনি। দীর্ঘ এক যুগ ধরে সুষ্ঠু তদন্তের অভাবে মামলার বোঝা টানছে পরিবারটি। স্বপন খান হয়েছেন এলাকাছাড়া। মামলার খড়গ আর ঋণের চাপে দিশেহারা দিনমজুর স্বপন খানের পরিবার। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের এমন পরিণতি বাবা যেমন মেনে নিতে পারছেন না, তেমনি সুখের সংসারে স্বামীর কষ্টে ব্যথিত স্ত্রী।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে ১২ ডিসেম্বর গুলশান এলাকায় ছিনতাইকালে বিদেশি অস্ত্রসহ আটক হন জাজিরার মুলনা ইউনিয়নের হামগাঁও এলাকার নুরু খানের ছেলে স্বপন খান। সেসময় থানায় মামলা হলে তার নামের স্থলে স্বপন খান ওরফে সুমন খান, পিতার নামের স্থলে মালেক খান ওরফে নুরু খান ও গ্রাম মতিসাগর উল্লেখ করা হয়। পরে ওই মামলায় ২০১০ সালে জামিনে মুক্তি পেয়ে গা ঢাকা দেন আসামি। পরে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে ঘটে বিপত্তি।
মামলার স্থলে নাম ও এলাকার মিল থাকায় গ্রেফতার করা হয় দিনমজুর স্বপন খানকে। বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে নিরপরাধ স্বপন খানকে জামিনে মুক্তি দেন। তবে এখনো মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য প্রতিনিয়ত আদালতের দারস্থ হতে হচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারটিকে।
স্বপন খানের স্ত্রী হাজেরা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মামলার প্রকৃত আসামি আমার স্বামী না। শুধু পুলিশের ভুলের কারণে আমার স্বামী এই মামলার আসামি হয়েছেন। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এখনো মামলার ঘানি টানছি। মামলার হাজিরা দিতে দিতে আমরা আজ নিঃস্ব।’
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী দেশে থাকতে পারেননি। আমার সন্তানদের মানুষ কটূ কথা বলেছে। এ ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের বিচার চাই। একইসঙ্গে ক্ষতিপূরণ চাই।’
স্বপন খানের বাবা আব্দুল মালেক খান বলেন, ‘আমার ছেলে এই মামলার বিষয়ে কিছুই জানতো না। ভুল ঠিকানা আর ভুল নাম দেওয়ায় আমরা ভুক্তভোগী হয়েছি। এতবছর হয়ে গেছে তবুও মামলা থেকে অব্যাহতি পাইনি।’
দিনমজুর স্বপন খান স্থানীয়দের কাছে একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত। শ্রম বিক্রি করে চলতো তার সংসার। তার সঙ্গে হওয়া এমন অন্যায় মানতে পারছেন না স্বজন ও এলাকাবাসী। দ্রুত এই মামলা থেকে মুক্তির দাবি তাদের।
স্থানীয় বাসিন্দা মর্জিনা বেগম বলেন, ‘স্বপন খা আমাদের চোখের সামনেই বড় হয়েছে। ওর বাবার যা ছিল এই মিথ্যা মামলার কারণে বিক্রি করে সব শেষ। শুধু নামের মিল থাকায় এই লোকগুলা হয়রানির শিকার হয়েছে।’
এদিকে প্রকৃত আসামি স্বপন খান ওরফে সুমন খানের বিষয়ে খোঁজ নিতে হামগাঁও এলাকায় গেলে মেলে সত্যতা। বর্তমানে তার পুরো পরিবারের কেউ থাকেন না বাড়িতে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এলাকায় আসেন না তারা। এক ব্যাংক ডাকাতির মামলায় স্বপন খান বর্তমানে কারাভোগ করছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তার বিরুদ্ধে রয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ডাকাতি, অস্ত্র, ছিনতাই, হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা।
স্বপন খান ওরফে সুমন খানের দূর সম্পর্কের আত্মীয় সালাম আকন বলেন, ‘স্বপন খান দীর্ঘদিন ধরে দেশে আসেন না। শুনেছি কোনো এক মামলায় উনি জেল খাটছেন। তার পরিবারের সবাই ঢাকা থাকেন।’
নিপা বেগম নামের এক প্রতিবেশী বলেন, ‘স্বপন খান ১০ বছর ধরে এলাকায় আসেন না। এক ব্যাংক ডাকাতির মামলায় ঢাকার জেলে আছেন বলে শুনেছি।’
আদালতের ছবি যাচাইয়ে দেখা যায়, দিনমজুর স্বপন খান প্রকৃত আসামি নন। শুধু নামের ওপর ভিত্তি করে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। রহস্য উন্মোচন করতে আরও অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন ছিল দাবি মানবাধিকার নেতাদের।
মানবাধিকার কমিশন শরীয়তপুরের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান বলেন, ‘শুধু একটি নামের ওপর ভিত্তি করে তদন্তকারী কর্মকর্তা তার দায়িত্বের অবহেলা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে উনি যদি সঠিকভাবে তদন্ত করতেন, তাহলে প্রকৃত ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে পারতেন। এটি সম্পূর্ণরূপে তার ব্যর্থতা। নামের বিভ্রান্তির কারণে যেই স্বপন খান ১২ বছর ধরে মামলার ঘানি টানছেন, আশা করি আদালত যাচাই-বাছাই শেষে তাকে মুক্তি দেবেন।’
এ ব্যাপারে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, এক ব্যক্তির পরিবর্তে আরেক ব্যক্তির নাম চার্জশিটে আসার বিষয়টি পুলিশ অবগত হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পেলে প্রকৃত আসামিকে শনাক্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিধান মজুমদার অনি/এসআর/জিকেএস