৬ বছর ধরে বন্ধ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্রাবাস
২৫ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে মানিকগঞ্জের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ। এখানে দূর-দূরান্ত থেকে পড়াশোনা করতে আসা দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের স্বল্প খরচে থাকা-খাওয়া নিশ্চিতের জন্য তৈরি হয় দুটি ছাত্রাবাস। তবে ছাত্রাবাস দুটির একটিও সচল নেই।
রাজনৈতিক অপতৎপরতা, বহিরাগতদের মাদক সেবন ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য ছয় বছর আগে ‘আলীমুল হক’ নামের ছাত্রাবাসটি বন্ধ করে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। অপর ছাত্রাবাসটি ১৫ বছর আগে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায়। সেখানে নতুন কোনো স্থায়ী ছাত্রাবাস তৈরি হয়নি এখনো। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে পড়ালেখা করতে আসা শিক্ষার্থীদের বাড়তি অর্থ খরচ করে অন্যত্র মেস অথবা বাসা ভাড়া করে থাকতে হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা যায়, আলীমুল হক ছাত্রাবাসের প্রধান ফটকে তালা। ভেতরে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ছাত্রাবাসের বাইরে ঝোপঝাড় এবং আগাছায় ভরে গেছে। এর উত্তর পাশে কলেজের জায়গায় মঞ্জুরুল আলম ছাত্রাবাসের পরিত্যক্ত টিনশেড কক্ষগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায়। তবে ভেতরে ব্যাডমিন্টনের পাকা ঢালাই করা কোট তৈরি করা আছে। কলেজের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ব্যবহার হয় এই ব্যাডমিন্টন কোট। কলেজটিতে ছেলেদের জন্য কোনো আবাসনব্যবস্থা না থাকলেও মেয়েদের জন্য দুটি সুবিশাল ছাত্রীনিবাস রয়েছে।
কলেজ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪২ সালে ২৩ দশমিক ৭৯ একর জমির ওপর কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা। তখন কলেজটির নাম ছিল ‘দেবেন্দ্র কলেজ’। ১৯৪৯ সালে এটি ডিগ্রি কলেজ হিসেবে উন্নীত হয়। ১৯৬৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান, ১৯৬৪ সালে ডিগ্রি বাণিজ্য কোর্স চালু হয়। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ডিগ্রি বিজ্ঞান কোর্স চালুর ফলে উন্নীত হয় পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি কলেজে।
১৯৭২ সালে বাংলা সম্মান কোর্স শুরু হয় কলেজটিতে এবং ১৯৭৬ সালে শুরু হয় উচ্চ মাধ্যমিক কৃষি কার্যক্রম। ১৯৮০ সালের ১ মার্চ সরকারিকরণ করা হলে কলেজের নাম হয় ‘সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ, মানিকগঞ্জ’। কলেজটিতে একাদশ, দ্বাদশ, ডিগ্রি পাস কোর্সসহ বর্তমানে ১৭টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৪টি স্নাতকোত্তর বিষয় রয়েছে। কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৯১১। এরমধ্যে ১২ হাজার ৪৫৪ জন ছাত্র এবং ১৩ হাজার ৪৫৭ জন ছাত্রী পড়ালেখা করছেন।
ছাত্রদের আবাসিক সমস্যা দূর করতে কলেজ প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর ১৯৪৭ সালে কলেজ ভবনসংলগ্ন পেছনের অংশের উত্তর পাশে টিনের দুটি ঘরে ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। পরে এর নামকরণ করা হয় ‘মঞ্জুরুল আলম ছাত্রাবাস’। ২০০৯ সালের ২ মার্চ ছাত্রাবাসটি আগুনে পুড়ে যায়। এরপর থাকার অনুপযোগী হয়ে পড়ায় ছাত্রাবাসটি অপসারণ করা হয়। এর ১৫ বছর পার হলেও নতুন কোনো স্থায়ী ছাত্রাবাসের উদ্যোগ নেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষার্থী বেড়ে যাওয়ায় আবাসিক সুবিধা নিশ্চিতে ১৯৯১ সালে কলেজের পশ্চিম পাশে আরও একটি দোতলা ‘আলীমুল হক’ ছাত্রাবাস করা হয়। ১৪টি কক্ষে ৫৬ জন ছাত্রের আবাসিক ব্যবস্থা ছিল ওই ছাত্রাবাসে। তবে পরবর্তী সময়ে গাদাগাদি করে শতাধিক ছাত্র থাকতেন। রাজনৈতিক অপতৎপরতা, ছাত্রাবাসে বহিরাগত ছেলেদের উৎপাত, মাদকের আসর এবং অসামাজিক কর্মকাণ্ডের কারণে ছাত্রাবাসে থাকা ছাত্ররা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ছাত্রাবাসটি বন্ধ করতে বাধ্য হয় কলেজ কর্তৃপক্ষ।
কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বলেন, কলেজে আবাসিক ব্যবস্থার এই নাজুক পরিস্থিতির কারণে অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় মেস এবং বাসা ভাড়া করে থাকছেন। এতে তাদের বাড়তি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের পরিবার পড়ছে বাড়তি চাপে।
কলেজ সংলগ্ন বনগ্রাম এলাকার একটি ফ্ল্যাটে মেস আকারে থাকেন কলেজের ছয় শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের ছাত্র মোবারক হোসেন বলেন, প্রতিমাসে তাদের ছয়জনের ৬ হাজার টাকা মেসভাড়া, গ্যাস ও রান্নার লোকসহ খাবারের জন্য প্রায় ২৩ হাজার টাকা খরচ পড়ে যায়। কলেজের ছাত্রাবাসে থাকলে এর অর্ধেক অর্থ খরচ হতো। এ ছাড়া মেস থেকে কলেজে যাতায়াতে বাড়ে রিকশাভাড়ার খরচ।
হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুজন রুহুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেলার তিনটি উপজেলার নদীভাঙন কবলিত দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার অনেক ছাত্র এই কলেজে পড়েন। কলেজে আবাসিক ব্যবস্থা থাকলে দরিদ্র পরিবারের এসব শিক্ষার্থীরা অল্প খরচে পড়ালেখার সুযোগ পেতেন। এছাড়া ছাত্রাবাসে নিরাপত্তার পাশাপাশি সময় এবং যাতায়াতের কষ্টও লাঘব হতো। এ বিষয়ে ছাত্ররা সোচ্চার হলে আমরা শিক্ষকরা তাদের সহযোগিতা করবো।’
সাধারণ ছাত্রদের পাশাপাশি আবাসনসংকট নিরসনের দাবি জানিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা। ২০১৯ সালে সংগঠনের পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়।
জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাহুল সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিরাপত্তা বিবেচনায় তখন ছাত্রাবাসটি উন্মুক্ত করতে সাহস পায়নি কলেজ প্রশাসন। দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এই কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। অথচ কলেজের ছাত্রদের আবাসনব্যবস্থা নেই। এতে চরম ভোগান্তি ও কষ্টের মধ্যে রয়েছেন ছাত্ররা। আবাসনসংকট দূর করতে আলীমুল হক ছাত্রাবাসটি খুলে দেওয়ার পাশাপাশি মঞ্জুরুল আলম ছাত্রাবাস নির্মাণের দাবি জানাই।’
সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) অ্যাডভোকেট জিন্নাহ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী সরকারের সময় অপরাজনৈতিকতায় কলেজের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। ছাত্রাবাসে বহিরাগতদের মাদক সেবন ও অসামাজিক কর্মকাণ্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রাবাস বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এতে দূরদূরান্ত থেকে পড়ালেখা করতে আসা দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে মেস কিংবা ফ্ল্যটে থাকতে হচ্ছে। ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের ছেলেরা বহিরাগতদের দিয়ে ক্যডার বাহিনী তৈরি করেছে। তারা সাধারণ শিক্ষার্থী ছেলে-মেয়ে উভয়কেই জোরপূর্বক দলীয় মিছিল-মিটিংয়ে নিয়ে গেছে। দীর্ঘ বছর ধরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন নেই।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতির চর্চা না থাকায় ছাত্রলীগের অপরাজনীতির শিকার হয়েছে জেলার এই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠটি। ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বৈষম্য নিপাত গেছে। শিক্ষার্থীরা এই বিষয়টা নিয়ে স্বোচ্চার হলে দ্রুত এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’
এ ব্যাপারে কলেজের অধ্যক্ষ মো. শহীদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিবেশটা এখন স্বাভাবিক। ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে আলিমুল হক ছাত্রাবাসটি খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। মঞ্জুরুল আলম ছাত্রাবাসটির জন্য জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেবে বলে জানিয়েছে জেলা শিক্ষা প্রকৌশল কর্তৃপক্ষ।’
এসআর/জিকেএস