ছদ্মনামে দেশে ঢুকছে ইয়াবা, ‘নিরাপদ রুট’ সিলেটের জকিগঞ্জ
কেউ বলেন ‘বিচি’, কেউ ‘বোতাম’। আবার কেউ কেউ ‘মাল’ নামেও ডাকেন। বিচি, বোতাম ও মাল—এ তিন নামেই ভারত থেকে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে অবাধে ঢুকছে ইয়াবা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে ইয়াবাকে এ তিনটি সাংকেতিক নামেই ডাকেন মাদক কারবারিরা। যে কারণে প্রকাশ্যে ইয়াবার কারবার চললেও ‘বোকা’ বানানো হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
সম্প্রতি সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে মাদক চোরাচালান অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইয়াবার এ তিনটি ‘সাংকেতিক’ নাম পাওয়া গেছে। এছাড়া ভারত থেকে জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা ঢোকার অভিনব কৌশলের তথ্যও ওঠে এসেছে জাগো নিউজের অনুসন্ধানে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকে সিলেটে চিনিকাণ্ড আলোচনায় থাকায় অনেকটা চাপা পড়েছে মাদকবিরোধী অভিযান। যে কারণে ‘নিরাপদ রুট’ হিসেবে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্তকে ব্যবহার করছেন চোরাকারবারিরা।
বিজিবির অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার হচ্ছে। তারপরও থেমে নেই চোরাকারবারিরা। অত্যন্ত কৌশলে কয়েক হাত বদল করে জকিগঞ্জ থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছেন এসব মাদক। এতে ‘সাপ্লাইয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে অসহায় ও হতদরিদ্র কিছু যুবককে। বিনিময়ে তাদের দেওয়া হয় চালানপ্রতি আর্থিক সুবিধা। ফলে মাদকবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছেন কেবল ‘সাপ্লাইয়াররা’। ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন মূল হোতারা।
সিলেট জেলার সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া) সম্রাট তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সীমান্তের বিষয়টি বিজিবির দেখার কথা। কিন্তু আমাদের কাছে যখন তথ্য আসে তখন আমরা চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান পরিচালনা করি। সম্প্রতি কম হলেও অতীতে বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করেছে পুলিশ।’
এ বিষয়ে বিজিবি জকিগঞ্জ ব্যাটালিয়নের (১৯ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার মো. আসাদুন্নবি বলেন, ‘কিছু কিছু সময় জকিগঞ্জ সীমান্তে নদীপথে মাদক আনার চেষ্টা করে। আবার শেওলা পয়েন্ট দিয়েও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমাদের নিয়মিত অভিযানের কারণে ব্যর্থ হয়।’
তিনি বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্যের আলোকে আমাদের কাছে মাদক কারবারিদের তালিকা আছে। আমরা সেই আলোকে অভিযান পরিচালনা করি। মাঝে মধ্যে গভীর রাতে চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান পরিচালনা করি। অনেক সময় ডগ স্কোয়াডের মাধ্যমেও আমাদের অভিযান চলে।’
অভিযানে মাদকের বাহক ধরা পরার বিষয়ে বিজিবি অধিনায়ক বলেন, ‘যখন অভিযান পরিচালনা করা হয় তখন মূলত বাহকই ধরা পড়ে। আমরা পরবর্তীতে ওই বাহককে মামলা দিয়ে থানায় হস্তান্তর করি। সে আলোকে মূল হোতাদের ধরার দায়িত্ব পুলিশের।’
যেভাবে সীমান্ত পার করা হয় ইয়াবার চালান
সিলেট শহর থেকে সবচেয়ে দূরের উপজেলা জকিগঞ্জ। ২৬৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ উপজেলার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৩ কিলোমিটার। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটিই ভারতের সীমান্তবর্তী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার বীরশ্রী ইউনিয়নের জিরোপয়েন্ট থেকে কসকনকপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত পর্যন্ত সবকটি এলাকা মাদক চোরাচালানের নিরাপদ রুট। স্থানীয় চোরাকারবারিরা সীমান্তের ওপার থেকে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা নিয়ে আসেন। পরে অত্যন্ত কৌশলে সারাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইয়াবা।
জকিগঞ্জ সীমান্ত এলাকার একাধিক সূত্র জানায়, মূলত তিনটি কৌশলে সীমান্তের কাটাতারের বেড়া ও নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে ইয়াবা। দিনের বেলা জেলে সেজে নদীতে নৌকা দিয়ে মাছ ধরার সময়, রাতের বেলা নদীতে ভাসিয়ে এবং রাতের আঁধারে সাঁতার কেটে ও নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে ইয়াবা নিয়ে আসেন চোরাকারবারিরা। পরে এগুলো সামীন্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামের বাড়িতে রাখা হয়। সেখান থেকে বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীদের এজেন্টের হাতে তুলে দেন স্থানীয় চোরাকারবারিরা। পরে যাত্রীবেশে গণপরিবহনে করে নিয়ে যান সিলেট নগরে। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচার করা হয় ইয়াবা। আবার কোনো সময় স্থানীয় চোরাকারবারিরা সরাসরি দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান মাদক।
একটি সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবার চালান অত্যন্ত কৌশলে ভারত থেকে কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে সীমান্ত পার করা হয়। দিনের বেলা নদীতে দুই দেশের জেলেরা নৌকা দিয়ে মাছ ধরেন। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ভারতের জেলে মাছ ধরার নামে অন্তত এক কিলোমিটার উজান থেকে মাঝ নদীতে প্যাকেটজাত করে ইয়াবা পানিতে ভাসিয়ে দেন। প্যাকেটে বিশেষ চিহ্ন থাকে যা বাংলাদেশের জেলেকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে ভেসে আসা সেই প্যাকেটটি পানি থেকে তুলে নৌকায় করে তীরে নিয়ে আসেন বাংলাদেশের জেলেরা।
রাতের বেলায়ও একইভাবে পানিতে ভাসিয়ে ভারত থেকে ইয়াবা পাঠানো হয় দেশে। তবে রাতের বেলা নৌকা ব্যবহার না করে সাতার কেঁটে মাঝ নদী থেকে ইয়াবার চালান সংগ্রহ করেন বাংলাদেশের চোরাকারবারিরা। এ কাজে অনেক সাহসী লোকদের ব্যবহার করা হয়।
রাতে নৌকায় নদী পার হয়ে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশ থেকে ইয়াবা নিয়ে আসেন বাংলাদেশিরা। এক্ষেত্রে ভারতের চোরাকারবারিরা ইয়াবার চালান কাঁটাতার অতিক্রম করে দেন।
একটি সূত্র বলছে, সম্প্রতি ইয়াবার একটি বড় চালান ভারতের অভ্যন্তরেই ধরা পড়ায় নদীতে ভাসিয়ে ইয়াবা আনা বন্ধ রয়েছে। তবে রাতের বেলা কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে চোরাচালান অব্যাহত রয়েছে।
জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম মুন্না জাগো নিউজকে বলেন, ‘সীমান্তবর্তী এলাকায় যাতে মাদক চোরাচালান বন্ধ করা যায়, আমরা সেজন্য কাজ করছি। আমাদের এখানে মাদক কারবারিদের তালিকা রয়েছে। প্রয়োজনে তালিকা ধরে কাজ করবো। তবুও কোনোভাবেই মাদক চোরাচালান করতে দেওয়া হবে না।’
সীমান্ত থেকে যেভাবে পোঁছায় সিলেট শহরে
প্রথম ধাপে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পার করার পর ইয়াবার চালান রাখা হয় সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামে। সাহসী এ কাজের জন্য যেসব চোরাকারবারি জড়িত তাদের মোটা অংকের মজুরি দেন মাদক কারবারিরা। তবে মাদকের যতবড় চালানই হোক, একদিনের বেশি কোনো বাড়িতে রাখা হয় না।
সূত্র জানায়, ভারত থেকে আনার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন স্থানীয় কারবারিরা। পরে সেখান থেকে স্থানীয় বিভিন্ন বাজার বা কোলাহলপূর্ণ এলাকায় অন্য ব্যবসায়ীর এজেন্টের কাছে তুলে দেন স্থানীয় কারবারিরা। চোরাচালানের পুরো প্রক্রিয়াতে কেউই ‘ইয়াবা’ নামটি ব্যবহার করেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে ইয়াবা শব্দ ব্যবহার না করে সাংকেতিক নাম হিসেবে ‘বিচি’, ‘বোতাম’ ও ‘মাল’ নামে ডাকা হয়। এতে করে প্রকাশ্যে ইয়াবার ব্যবসা করা হলেও কেউই টের পান না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ইয়াবার চালান বুঝে নেওয়ার পর বড় ব্যবসায়ীর এজেন্টরা বাস বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে সাধারণ যাত্রীবেশে সিলেট নগরীতে নিয়ে আসেন। ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে গণপরিবহনে ওঠার আগে পরনের কাপড় বদলে ফেলেন তারা। এতে গোপন তথ্য পেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের শনাক্ত করতে পারেন না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ
গত ২৮ নভেম্বর সিলেটের গোলাপগঞ্জ থেকে ৩৭ হাজার ৫০০ পিস ইয়াবাসহ দুজনকে গ্রেফতার করে র্যাব-৯। অথচ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সিলেট জেলায় চলতি বছরের ১০ মাসে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মাত্র ৯ হাজার ১৩৩ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে। যদিও মাদক নিয়ন্ত্রণ ও চোরাচালান রোধে সরকারের এ দপ্তরের সরাসরি গ্রেফতার ও মামলা করার এখতিয়ার আছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সিলেট জানায়, গত এক বছরে সিলেটে এক হাজার ১৩৬টি অভিযানে ইয়াবা ছাড়াও ৩৫ কেজি ৮৭৪ গ্রাম গাঁজা, সাত বোতল ফেনসিডিল, ১৪৩ বোতল বিদেশি মদ, ১১০ বোতল বিয়ার, ২১১ লিটার চোলাই মদ ও ১৫১০ লিটার ওয়াশ জব্দ করা হয়েছে। এসব অভিযানের ঘটনায় ২৬১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ২৪০ জনকে। পলাতক রয়েছেন ২২ জন।
এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মলয় ভূষণ চক্রবর্তী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের কাছে তালিকা রয়েছে কারা মাদকের সঙ্গে জড়িত। জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে মাদক একেবারে কম আসে। তবুও আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’
তিনি বলেন, আমরা অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। তবে মাদক কারবারিদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এ পেশা থেকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন বলেও জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা।
আহমেদ জামিল/এসআর/জিকেএস