উধাও বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন

‘টাকা ফেরত না পেলে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না’

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি নওগাঁ
প্রকাশিত: ১০:৩৭ এএম, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

নওগাঁ সদর উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের চাকলা গ্রামের বাসিন্দা গৃহবধূ নাসিমা বেগম। অভাব অনটনের সংসারে অটোরিকশাচালক স্বামীকে সহযোগিতা করতে ছয় বছর আগে অন্যের জমিতে গোয়ালঘর তৈরি করে গরু-ছাগল পালন শুরু করেছিলেন। ইচ্ছে ছিলো এ খামার থেকে উপার্জিত আয় দিয়ে জমি কিনে ছোট্ট একটি সেমিপাকা বাড়ি তৈরি করবেন। ওই বাড়ির উঠানে থাকবে নিজস্ব গোয়াল ঘর। সচ্ছলতা ফিরবে সংসারে।

গরু-ছাগল বিক্রির পর গত বছর নাসিমার হাতে জমা হয় নগদ তিন লাখ টাকা। এরপরই অজানা এক লোভ পেয়ে বসে নাসিমাকে। প্রতিবেশীর মাধ্যমে সন্ধান পান নওগাঁ শহরের পোস্ট অফিস পাড়ায় অবস্থিত বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের। যেখানে প্রতি এক লাখ টাকা জমা রাখার বিপরীতে লাভ দেওয়া হতো দুই হাজার টাকা। সেখানে তিন লাখ টাকা জমা রেখে পাঁচ মাসে লাভ পান ৩০ হাজার টাকা।

এদিকে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের পর গত ১২ নভেম্বর হঠাৎই সপরিবারে লাপাত্তা হোন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন তনু। পাওনা টাকা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা প্রতিষ্ঠানটির সবকটি শাখায় তালা ঝুলিয়ে দেন। থানা ও আদালতে কয়েকটি মামলা করেন কয়েকশ গ্রাহক। সবকিছুর পর এখন লাভ তো দূরের কথা আসল টাকা আদৌ ফেরত পাবেন কি না সেটি নিয়ে চরম দুঃশ্চিন্তায় দিন পার করছেন গৃহবধূ নাসিমা বেগম।

বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে নাসিমার মতো টাকা জমা রেখে এমন বিপাকে পড়েছে কয়েকশ গ্রাহক।

ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অভিযোগ, নাজিম উদ্দিন তনু তাদের ৫০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়েছে। থানা ও আদালতে মামলার পাশাপাশি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের কাছেও অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। গত ১ ডিসেম্বর ভুক্তভোগীরা সড়ক অবরোধের পর পুলিশ সুপার তনুকে দ্রত গ্রেফতারের আশ্বাস দিলেও এখনো সে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তনুর পালিয়ে যাওয়ার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না পুলিশ।

‘টাকা ফেরত না পেলে আত্মহত্যা ছাড়া উপাই থাকবে না’

নওগাঁ সদর উপজেলার জোকাবিলা গ্রামের বাসিন্দা ভুক্তভোগী বৃদ্ধা জুলেখা বেগম বলেন, অন্যের বাড়িতে কাজ করে তিলে তিলে এক লাখ টাকা জমিয়েছিলাম। মেয়ে ঢাকার একটি গার্মেন্টসে কাজ করে আড়াই লাখ টাকা জমিয়েছিলো। এসব টাকা বাড়িতে ফেলে না রেখে প্রতিবেশীদের পরামর্শে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে জমা রেখেছিলাম। গত দুই বছর লাখে দুই হাজার টাকা করে লাভ পেয়েছি। তাই সাহস করে আরও ৫০ হাজার টাকা ডিপিএস করেছিলাম। ওই চার লাখ টাকা ফেরত না দিয়েই তনু পালিয়েছে। জীবনের শেষ সম্বলের এই টাকা ফেরত না পেলে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

আরেক ভুক্তভোগী মহাদেবপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের কুশা সেন্টার মহল্লার বাসিন্দা খায়রুন আক্তার ১২ বছর আগে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের সদস্য হয়েছিলেন। দীর্ঘ সময় সদস্য থাকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রতি বিশ্বাস জমেছিলো। তাই ঝুঁকির চিন্তা না করেই নিজের নামে ছয় লাখ ৫৩ হাজার টাকা, মাদরাসা পড়ুয়া ছেলের নামে ১০ লাখ এবং মেয়ের জামাইয়ের নামে আরও ৪০ লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন খায়রুন আক্তার। সেই টাকা ফেরত পাওয়ার অনিশ্চয়তায় এখন অসুস্থ হয়ে থানা, আদালতসহ প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।

খায়রুন আক্তার বলেন, টানা এক বছর ৫৮ লাখ টাকা জমা রাখার বিপরীতে প্রতি লাখে দুই হাজার টাকা করে লাভ পেয়েছি। গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গ্রাহকদের চাপের মুখেও লাভের অর্ধেক টাকা পরিশোধ করেছিলো তনু। এরপর পুরো টাকা ফেরত চাইলে সময় চেয়েছিলো। কিন্তু এর মধ্যেই টাকা ফেরত না দিয়ে পালিয়ে গেলো। জীবনের শেষ সম্বল হারালে আমরা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে যাবো।

একই উপজেলার গার্লস স্কুল মোড় এলাকার বাসিন্দা রোকেয়া আক্তার বলেন, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের মহাদেবপুর শাখায় আমার মেয়ে মাঠকর্মী হিসেবে চাকরি করতেন। সেখানে মেয়েকে সঞ্চয়ের টার্গেট পূরণে প্রচুর চাপে রাখতো প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। তাই চাপের মুখে আমাকে সদস্য দেখিয়ে নিজেদের শেষ সম্বল ১০ লাখ টাকা ওই প্রতিষ্ঠানে জমা রেখেছিলো মেয়ে। দুই বছরে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা লাভ পেয়েছি। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে লাভের টাকা দেওয়া হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। এতো দ্রুত প্রতিষ্ঠানটি হারিয়ে যাবে মাঠকর্মী হওয়ার পরেও আমার মেয়ে বুঝতে পারেনি।

জেলা সমবায় অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন এ দুটি দপ্তরের নিবন্ধন ছাড়াই এতোদিন কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলো। যৌথ মূলধন কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নিলেও সংস্থাটির ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনায় প্রয়োজনীয় মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি (এমআরএ) সনদ ছিলো না। এরপরও নিজেদের সমবায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠানটি হাজারো গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

‘টাকা ফেরত না পেলে আত্মহত্যা ছাড়া উপাই থাকবে না’

অনুসন্ধান বলছে, ২০০৯ সালে নওগাঁয় কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মূল টার্গেট ছিলো ক্ষমতাসীন দলের হেবিওয়েট নেতা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে আধিপত্য বিস্তার করা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীসহ প্রভাবশালী নেতাদের নির্বাচন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে মাসিক ও বাৎসরিক মাসোয়ারা দিত বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন তনু। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তনুর থেকে বিভিন্ন সময়ে নিতেন বিশেষ সুবিধা। তাই ক্ষমতার দাপটে নিয়ম নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ব্যাংক ও সংস্থাগুলোর চেয়েও বেশি মুনাফা দেওয়ার লোভ দেখাতেন তনু। মাসিক ও বার্ষিক আমানত প্রকল্প, স্থায়ী বিনিয়োগ ও স্থায়ী আমানত প্রকল্পসহ নামে বেনামে বিভিন্ন প্রকল্প ছিলো তনুর এ প্রতিষ্ঠানের। এভাবেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তনু।

এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন তনুর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) গাজিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, নাজিম উদ্দিন তনু যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে সে বিষয়টি ইমিগ্রশনে কথা বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। তার ব্যাংক হিসাব স্থগিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তনুকে গ্রেফতারে সর্ব্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ।

আরমান হোসেন রুমন/এএইচ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।