উত্তরে সারের ‘কৃত্রিম সংকট’, বিপাকে কৃষক
উত্তরাঞ্চলের কৃষিপ্রধান এলাকাগুলোতে চলতি রবি মৌসুমে কৃত্রিম সারের সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম জেলায় এই সংকট আরও গভীর আকার ধারণ করেছে। ডিলার, সাব-ডিলার এবং খুচরা বিক্রেতারা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ২০০-৩০০ টাকা বেশি দামে ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) এবং মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার বিক্রি করছেন।
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার টেপাখরিবাড়ি ইউনিয়নের কৃষক আবুল কালাম। তিনি বলেন, এখন আলু, গম ও ভুট্টার মৌসুম চলছে। এসময়ে সার না পেলে ফসলের উৎপাদনে বড় ধরনের ক্ষতি হবে। অথচ ডিলাররা সংকটের অজুহাতে সরাসরি সার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। খুচরা বিক্রেতাদের কাছে গেলে তারা অতিরিক্ত দাম হাঁকেন।
ডিমলার বাইশপুকুর গ্রামের কৃষক মোত্তালেব হোসেন অভিযোগ করেন, ডিলাররা রাতে চুপিসারে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সার সরবরাহ করেন। আমাদের কাছে বলছেন, সার নেই। উপজেলা প্রশাসনের নজরদারির অভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
দিনাজপুর সদর ও বিরামপুর উপজেলায় সার মজুতের অভিযোগ উঠেছে। চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষক আমিনুল হক বলেন, ‘ডিলারের কাছে গেলে তারা বলে সার নেই। অথচ গুদামে সার মজুত আছে। বেশি দামে বিক্রির জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সংকট তৈরি করা হচ্ছে।’
হাকিমপুর উপজেলার কৃষি অফিসার আরজেনা বেগম বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে সারের মজুত রেখে বাজারে সংকট তৈরি করছেন। আমরা অভিযান চালিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সারের দাম বাড়ার কারণে চাষাবাদের খরচ বেড়ে গেছে বলে জানান ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার কৃষক আকরাম হোসেন।
তিনি বলেন, প্রতিবস্তা টিএসপি ২০০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এতে গম ও আলু চাষে খরচ বাড়ছে। লাভের আশায় চাষ করতে গিয়ে আমরা ক্ষতির মুখে পড়ছি।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার ব্যবসায়ী মতলেবুর রহমান দাবি করেন, সরকার থেকে সরবরাহ কম হওয়ায় কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী সার দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ সঠিক নয়।
রংপুরের গঙ্গাচড়া ও পীরগাছা উপজেলায় সারের সংকট প্রকট। কৃষক আলফাজ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, সার না পাওয়ায় অনেক জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হচ্ছি। প্রতিবস্তা এমওপি ২৫০ টাকা বেশি দিয়ে কিনেছি।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় সারের চাহিদা বাড়লেও সংকট দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন ডিলাররা। কৃষক সাদেকুল ইসলাম বলেন, ডিলাররা সরাসরি বিক্রি না করে খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায়ও একই পরিস্থিতি। প্রান্তিক কৃষকদের অভিযোগ, সারের জন্য প্রতিদিন ডিলারের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তারপরও সার মেলে না। তবে দাম বেশি দিলেই সার পাওয়া যায়।
সার সংকট চাষাবাদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও সাঘাটা উপজেলায়। আলুচাষি আব্দুল করিম বলেন, সংকটের কারণে জমিতে সঠিক পরিমাণে সার দিতে পারছি না। এতে ফলন কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
সাঘাটা উপজেলায় কৃষকদের অভিযোগ, সারের দাম বেশি নেওয়ার পাশাপাশি অনেক ডিলার রসিদ দিচ্ছেন না। এতে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে।
তবে নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুরের জেলা প্রশাসকরা জানিয়েছেন, সারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি উপজেলায় জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিলের মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
নীলফামারীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, আমরা বিষয়টিতে নজর রাখছি। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া আছে।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য সরকারকে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি ডিলারদের কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার দাবি জানান কৃষি বিশেষজ্ঞ বজলুর রহমান।
তিনি বলেন, সার ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সঠিক রসিদ নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কৃত্রিম সংকট রোধে স্থানীয় প্রশাসনকে কার্যকরভাবে মাঠ পর্যায়ে নজরদারি করতে হবে। কারণ এই সংকট নিরসন না হলে উত্তরাঞ্চলের খাদ্যশস্য উৎপাদনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
এসআর/জিকেএস