শতাধিক চোরাই মোবাইল ফোন উদ্ধারের পর ছয়টি জব্দ দেখালো ডিবি
নওগাঁয় চোরাচালানবিরোধী অভিযানে শতাধিক ভারতীয় স্মার্টফোন উদ্ধারের পর মাত্র ৬টির তথ্য জব্দ তালিকায় উল্লেখ করার অভিযোগ উঠেছে জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোফাজ্জল হোসেনের বিরুদ্ধে।
গত ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে জেলার মান্দা উপজেলার ভাঁরশো ইউনিয়নের দেলুয়াবাড়ী-চৌবাড়িয়া আঞ্চলিক সড়কের বাদশাহ ভাইয়ের মোড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে নাটকীয়ভাবে সময় ও স্থান পাল্টে স্থানীয় থানায় এ মামলা দায়ের করেন তিনি। এ ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে ওই এলাকায়। বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
মান্দা থানায় দায়েরকৃত এজাহার অনুযায়ী, গত ১৭ নভেম্বর রাত ৯টা ৫ মিনিটে উপজেলার ভাঁরশো ইউনিয়নের দেলুয়াবাড়ী-চৌবাড়িয়া রোডের বাদশাহ ভাইয়ের মোড় এলাকার শখের বাড়ী নামক রেস্তোরাঁর সামনে অভিযান পরিচালনা করেন জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা। অভিযানে ওই এলাকা থেকে একটি ব্যাগে ভারতীয় সীমান্ত থেকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে সংগ্রহ করা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ১ লাখ ৬ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের ৬টি মোবাইল ফোনসহ আমানুল্লাহ শিহাব (২২) ও নাহিদুজ্জামান তুষার (২৩) নামে দুইজন চোরকারবারীকে আটক করা হয়।
উদ্ধার করা এসব মোবাইল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ডিবি পুলিশের কাছে থাকা টর্চ লাইটের আলোতে দেখিয়ে এসকেন্দার আলী ও আনারুল ইসলাম নামে দুই যুবকের থেকে জব্দ তালিকায় স্বাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। নওগাঁ জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোফাজ্জল হোসেন, কনস্টেবল শেখ ফরিদ ও মকলেছুর রহমানসহ ডিবি পুলিশের সঙ্গীয় ফোর্স মাদকবিরোধী এই অভিযান পরিচালনা করেন। পরে ২ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে রাত ১২টা ৫ মিনিটে মান্দা থানায় বাদী হয়ে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোফাজ্জল হোসেন।
তবে অনুসন্ধানে ডিবি পুলিশের দায়ের করা ওই মামলার বিরুদ্ধে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। দেলুয়াবাড়ী-চৌবাড়িয়া রোডের শখের বাড়ী রেস্তোরাঁর সামনে ওইদিন রাত ৯টা ১৫ মিনিটে ডিবি পুলিশ কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি। তবে ওই রেস্তোরাঁ থেকে কিছুটা দূরে চৌবাড়িয়া ব্রিজ পেরোলেই বাদশাহ ভাইয়ের মোড়। ওই মোড়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে অভিযান চালিয়ে আমানুল্লাহ শিহাব নামে এক যুবকের থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকা মূল্যের ব্যাগভর্তি শতাধিক চোরাই পথে আসা স্মার্টফোন উদ্ধার করা হয়। এরপর তড়িঘড়ি করে উদ্ধারকৃত মোবাইলসহ চোরাকারবারী আমানুল্লাহ শিহাবকে আটক করে সেখান থেকে সটকে পড়ে ডিবি পুলিশের সদস্যরা।
অভিযানের প্রায় ১ ঘণ্টা পর আমানুল্লাহ শিহাবকে নিয়ে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী নিয়ামতপুর উপজেলার জোনাকী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে। সেখান থেকে আরেক চোরাকারবারী নাহিদুজ্জামান তুষারকে আটক করে ডিবি পুলিশ। আটকের কারণ জানতে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে কৌশলে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় উঠিয়ে নাহিদুজ্জামান তুষার ও আমানুল্লাহ শিহাবকে আবারো নেওয়া হয় মান্দা উপজেলার চৌবাড়িয়া ব্রিজ এলাকায়। ডিবি পুলিশ ও চোরকারবারীরা ছাড়াও ওই অটোরিকশার যাত্রী ছিলেন জোনাকী গ্রামের বাসিন্দা কৃষক আনারুল ইসলাম।
চৌবাড়িয়া ব্রিজ এলাকায় নামার পর কৃষক আনারুল ইসলাম ও অটোরিকশা চালক এসকেন্দার আলীর থেকে জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর নেওয়া হয়। তবে স্বাক্ষরের আগে জব্দকৃত আলামতের বর্ণনা তাদের দেওয়া হয়নি।
জব্দ তালিকায় স্বাক্ষরের বিষয়ে জানতে চাইলে এসকেন্দার আলী বলেন, ওই দুইজনকে গ্রেফতারের কারণ না জানিয়েই আমার থেকে জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর নিয়েছে ডিবি পুলিশ। তাদের কাছ থেকে কী উদ্ধার করা হয়েছিল, সেটিও আমাকে বলা হয়নি। অটোরিকশায় করে চৌবাড়িয়া নামিয়ে দেওয়ার পর ভাড়াও পরিশোধ করেনি পুলিশ।
অপর সাক্ষী আনারুল ইসলাম বলেন, জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর নিলেও কী পরিমাণে অবৈধ জিনিস উদ্ধার হয়েছে সেটি না জানিয়েই এলাকা থেকে ওইদিন সটকে পড়েছিল ডিবি পুলিশ। ওই সময় জোনাকীর মোড়ে অনেকে ভিড় জমলেও কাউকে উদ্ধারকৃত আলামতের বর্ণণা দেওয়া হয়নি।
শখের বাড়ী রেস্তোরাঁর স্বত্তাধিকারী দিপু সরকার বলেন, ডিবি পুলিশ ওইদিন আমার রেস্তোরাঁর আশপাশে কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি। চৌবাড়িয়া ব্রিজ পেরোলেই বাদশাহ ভাইয়ের মোড়। ওই মোড়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে অভিযান চালিয়ে কয়েকশ অবৈধ মোবাইলসহ একজনকে আটক করেছিল তারা। এরপর তারা বেশিক্ষণ এখানে অপেক্ষা করেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পার্শ্ববর্তী ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ওইদিন কয়েকশ স্মার্টফোন অবৈধভাবে এনেছিলেন আমানুল্লাহ শিহাব। ওইসব মোবাইল বাহির থেকে আসা কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল। ওইসব ব্যবসায়ীদের সূত্রেই ডিবির এসআই মোফাজ্জল হোসেন আমানুল্লাহ শিহাবের সন্ধান পান এবং প্রায় ২০ লাখ টাকা মূল্যের স্মার্টফোনসহ তাকে হাতেনাতে আটক করেন। এরপর রফাদফার মাধ্যমে ফোনগুলো কালোবাজারে বিক্রি করে মাত্র ৬টি জব্দ তালিকায় দেখানো হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোফাজ্জল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ৬টি মোবাইলসহ ওই দুইজনকে আটকের পর টর্চ লাইটের আলোয় সাক্ষীদের দেখানো হয়েছে। এরপরই দুইজন জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর করেছেন। শতাধিক মোবাইল উদ্ধারের পর কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগটি সঠিক নয়।
নওগাঁ জেলা গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক (ডিবি) আব্দুল মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, সময় হেরফের হলেও এজাহারে স্থান পাল্টে ফেলার সুযোগ নেই। জব্দকৃত আলামত সাক্ষীদের সামনে দেখিয়ে তারপরই স্বাক্ষর নেওয়ার নিয়ম। ভারতীয় মোবাইল ফোন উদ্ধার অভিযানে নয়-ছয় হয়ে থাকলে সেটি ক্ষতিয়ে দেখা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না।
আরমান হোসেন রুমন/এফএ/এমএস