জেলে সুরক্ষায় ‘অপর্যাপ্ত’ আইন

কাজল কায়েস কাজল কায়েস , জেলা প্রতিনিধি, লক্ষ্মীপুর
প্রকাশিত: ০৮:২০ এএম, ২৯ অক্টোবর ২০২৪

উপকূলীয় ১৯ জেলার ১০ লক্ষাধিক জেলের গলার কাঁটা ঋণ-দাদন। এ পেশায় রয়েছে জীবনের ঝুঁকি, দুঃখ-কষ্ট-আহাজারি। মরেও রক্ষা হয় না। পরিবারকেই টানতে হয় ঋণের বোঝা। দেশের জেলে সুরক্ষা আইনটিও সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত নয়। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় ঠিকমতো পৌঁছায় না প্রণোদনা। এ পেশার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নেই সরকারের কোনো পরিকল্পনা। জেলেদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রতিনিধি কাজল কায়েসের তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় ও শেষ পর্ব

জেলেদের সুরক্ষার কার্যত কার্যকর কোনো আইন নেই। যেটা আছে সেটারও নেই তেমন কোনো ভূমিকা। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে নীতিমালায় যে আর্থিক সহযোগিতার কথা বলা আছে সেটার কথা অধিকাংশ জেলে জানেনই না। যারা জানেন তারাও ঠিকমতো পান না বলেই অভিযোগ।

দাদনপ্রথা সম্পূর্ণ বেআইনি। আইনের দৃষ্টিতে দাদন অবৈধ। অথচ যুগ যুগ ধরে দাদন গ্রাস করে রেখেছে গোটা জেলে সমাজকে। আবার এনজিও-সমিতির ঋণ-কিস্তির বেলায়ও রয়েছে সুনির্দিষ্ট আইন। কিন্তু বাস্তবে এসব দেখভালের কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও থাকেন জবাবদিহিতার বাইরে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ কারবারিদের ইচ্ছামতো শোষণ-পীড়নের শিকার হচ্ছেন জেলেরা।

মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, খাদ্যনিরাপত্তা ও জীবিকায়ন সচল রাখার জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত জেলেদের ‘নিহত জেলে পরিবার বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেদের আর্থিক সহায়তা নীতিমালা- ২০১৯’ রয়েছে। এতে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত-জলদস্যুদের হামলায় নিহত বা নিখোঁজ নিবন্ধিত জেলের পরিবারকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা এবং একই ধরনের কারণে স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেকে ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তার নির্দেশনা রয়েছে।

কিন্তু জেলেদের অভিযোগ, আর্থিক সহায়তার বিষয়টি অধিকাংশ জেলেই জানেন না। প্রচার-প্রচারণা নেই। এছাড়া আবেদন করেও সহায়তা পাননি অনেকেই।

জেলেদের আর্থিক সহায়তা নীতিমালা সংশোধন করা প্রয়োজন। ৫০-২৫ হাজার টাকা সময়পোযোগী নয়। এটি বাড়ানো দরকার। তাহলে মৃত জেলেদের দায়-দেনা পরিশোধসহ সঞ্চিত টাকা পরিবারের কাজে আসবে।- সমাজ উন্নয়নকর্মী সানা উল্লাহ সানু

লক্ষ্মীপুরের সমাজ উন্নয়নকর্মী সানা উল্লাহ সানু জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেলেদের আর্থিক সহায়তা নীতিমালা সংশোধন করা প্রয়োজন। ৫০-২৫ হাজার টাকা সময়পোযোগী নয়। এটি বাড়ানো দরকার। তাহলে মৃত জেলেদের দায়-দেনা পরিশোধসহ সঞ্চিত টাকা পরিবারের কাজে আসবে।’

সূত্র জানায়, জাটকা শিকার বন্ধের সময় চার মাস নিবন্ধিত জেলেরা মাথাপিছু ৪০ কেজি করে চাল আর মা ইলিশ শিকার বন্ধের সময় ২২ দিন মাথাপিছু ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়ার কথা সরকারের। এছাড়া স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কিছু জেলেদের মধ্যে গরু-বাছুরও বিতরণ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, নিবন্ধিত সব জেলে একই সময়ে খাদ্যসহায়তা পান না। আবার যারা পান, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে অভিযোগ আছে। প্রায় সব এলাকায় নিবন্ধিত জেলেদের মাঝে চাল বিতরণে স্বজনপ্রীতি, ওজনে কম দেওয়া, টাকা আদায়, কালোবাজারে বিক্রিসহ অনিয়মের ভুরি ভুরি অভিযোগ মিলেছে।

চরবংশী গ্রামের আলতাফ হোসেন বেপারী বলেন, মাছ ধরতে গিয়ে আমার ভগ্নিপতি ও ভাগনে মারা গেছেন। কিন্তু আবেদন নিয়ে দ্বারে দ্বারে অনেক ঘুরেও সহায়তা পাইনি।

১৮৬৮ কোটিতে এই হাল

মৎস্য বিভাগের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ’ নামে প্রকল্পে দেশের উপকূলীয় ১৬টি জেলার ৭৫টি উপজেলা এবং ৭৫০টি ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৮৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। জেলেদের জীবনমানের পরিবর্তন ও ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে।

কিন্তু রাষ্ট্রের এত টাকা ব্যয়ে জেলেদের জীবনমানের পরিবর্তন ও ভাগ্যোন্নয়ন আদৌ হচ্ছে কি না সেটা নিয়ে রয়েছে হাজারো প্রশ্ন।

জেলে ছায়েদ গাজীর বাড়ি রায়পুরের চরবংশী গ্রামে। বড়নাইয়া বাড়িতে ছিল তার বসবাস। ছায়েদের ২৫ লক্ষাধিক টাকা বিনিয়োগের দুটি ইঞ্জিন ট্রলার ছিল। জালসহ মাছ ধরার সরঞ্জামেরও কমতি ছিল না। স্ত্রী, পাঁচ মেয়ে, এক ছেলেসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভালোই যাচ্ছিল দিনকাল। ২০২২ সালে মাছ ধরতে গিয়ে সাগরে তার একটি ট্রলার ডুবে যায়। ভোলার ঢালচর থেকে কোস্টগার্ডের সদস্যরা ওই ট্রলারের ১৪ জেলেকে উদ্ধার করেন। এছাড়া স্থানীয় বিরোধ কেন্দ্র করে গত ইউপি নির্বাচনের পর বাড়ির পাশে সংযোগ খালে থাকা অন্য ট্রলারটি জালসহ পুড়িয়ে দেয় প্রতিপক্ষের লোকজন। সব হারিয়ে ছায়েদের পথে বসার উপক্রম।

এটা আমাদের ব্যবসা। জেলেরা আমাদের কাছে জিম্মি- এটা পুরোপুরি ঠিক না হলেও এ কথার সত্যতা আছে। সব পাইকার আর দাদনদার তো এক নয়। ছাড় দেওয়ার মানসিকতাও সবার ভিন্ন ভিন্ন।-আড়তদার আমির হোসেন

এরপর মহাজন আর এনজিওর দারস্থ হন তিনি। একে একে চড়া সুদে ভোলার চরফ্যাশনের আড়তদার জয়নাল বেপারীর কাছ থেকে ৯ লাখ, রায়পুরের চরবংশীর মোক্তারের এক লাখ ৭০ হাজার, কোডেকের ৬০ হাজার, গ্রামীণ ব্যাংকের ৮০ হাজারসহ বিভিন্নজনের কাছ থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ঋণ করেছিলেন। কিন্তু নদী-সাগরে আশানুরূপ মাছ না পাওয়ায় ঋণের কিস্তির চাপে পিষ্ট হচ্ছিলেন ছায়েদ। দিশেহারা হয়ে গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে ছায়েদ পরিবার নিয়ে গোপনে রাতের আঁধারে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। এখন কোথায়, কীভাবে আছেন, জানে না কেউ।

গত ৮ জুলাই দুপুরে ছায়েদের বাড়ির সামনের চা দোকানে বসে কথা হয় তার ছোট ভাই মিনার হোসেনের সঙ্গে। ‘ভাইয়ের পাওনাদারদের কারণে সমাজে, রাস্তাঘাটে অপদস্থ হতে হয় জানিয়ে মিনার বলেন, ‘পাওনাদাররা আমাকে রাস্তায় বের হতে, এমনকি কাজ করতেও দেবেন না বলে হুমকি দিচ্ছে। বাড়িতে এসে তারা খারাপ ব্যবহার করে। এ নিয়ে গ্রামে ইউপি সদস্য আলতাফ জমাদার, জেলে সংগঠক মোস্তফা বেপারীসহ অনেকেই সালিশ-বৈঠকও করেছেন।

জেলে সুরক্ষায় ‘অপর্যাপ্ত’ আইন

চাঁদপুরের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাছের আড়ত হাইমচরের চরভৈরব মাছঘাট। সেখানে ২৩টি গদিঘর রয়েছে। একেকজন গদি-মালিক এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত জেলেদের কাছে দাদন বিলি করেছেন।

নাইম ফিশ ট্রেডার্সের মালিক নজরুল ইসলাম ফকির বলেন, ‘দাদন ছাড়া কোনো জেলে নেই। যাদের একসময় তিন-চারটা ট্রলার ছিল, এখন একটাও নেই। একেকজন জেলে বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, ভোলা ও চাঁদপুরের পাঁচ-সাতজনের কাছ থেকে দাদন নেয়। আমারও জেলেদের কাছে চার-পাঁচ কোটি টাকা দাদন রয়েছে। দাদন দেওয়ার সময় আমরা ধরেই নিই ২৫ শতাংশ টাকা পাবো। মৃত্যুর পর সামর্থ্যহীন জেলেদের আমরা পাওনা টাকা মওকুফ করে দিই।’

চাঁদপুর মাছঘাটের আড়তদার আমির হোসেনের দাদন রয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের ব্যবসা। জেলেরা আমাদের কাছে জিম্মি- এটা পুরোপুরি ঠিক না হলেও এ কথার সত্যতা আছে। সব পাইকার আর দাদনদার তো এক না। ছাড় দেওয়ার মানসিকতাও সবার ভিন্ন ভিন্ন।’

আলতাফ মাস্টার ঘাটের মালিক রায়পুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘জেলেদের কাছে আমার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঘাটটি দখল হয়ে গেছে। এখন আর এক টাকাও পাবো না।’

তবে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বড় গলায় বলেন, সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের মাধ্যমে জেলেদের জীবনমানের পরিবর্তনে কাজ করা হচ্ছে। কলাপাড়ার ১২টি গ্রামে দলবদ্ধভাবে ৫৫ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেকটি দলে ১১০ থেকে ১২০ জন জেলে রয়েছে। বরিশাল বিভাগে ২৯টি উপজেলায় এ কার্যক্রম চলছে।’

দায়সারা নিবন্ধন

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বেচ্ছাসেবী, মানবিক, সামাজিক ও অলাভজনক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার অঙ্গীকার করে অনেকেই স্থানীয় সমাজসেবা ও সমবায় অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নেন। ‘মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম করা যাবে না’-এই প্রধান শর্তে তারা নিবন্ধন পান। অথচ পরে তারা প্রকাশ্যেই রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে।

সবশেষ ২০০৬ সালের এক আইন অনুসারে লাইসেন্স ও অনুমতি ছাড়া এ ধরনের লেনদেন অবৈধ করা হয়। ওই বছর কার্যকর হওয়া মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি নামের আইনে বলা হয়, যারা ক্ষুদ্রঋণ দেয় এবং সুদ নেয়, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির কাছ থেকে তাদের লাইসেন্স ও অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া কেউ যদি এ ধরনের ধার বা ঋণ দেয়, তাহলে এই আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী সেটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। কেউ এই আইন অমান্য করলে তার এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।

এরপরও কেউ কেউ দায়সারাভাবে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) বা পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) অনুমতি নিয়ে ঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তিন মাস পরপর এমআরএ প্রতিনিধিরা লক্ষ্মীপুর সোপিরেট অফিসে এসে সভা করে ‘দায় সারেন’। শতকরা ১০ টাকার ওপরে বার্ষিক মুনাফা না নেওয়ার জন্য এমআরএ এবং পিকেএসএফ-এর নির্দেশনা থাকলেও অধিকাংশ এনজিও সংস্থা কূটকৌশলে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করছে।

এছাড়া সমবায় থেকে নিবন্ধন নেওয়া সংস্থাগুলোর (মাল্টিপারপাস) শুধু নিজেদের সদস্যদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদানের নিয়ম থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই এরা শর্ত ভেঙে নতুন নতুন সদস্য সৃষ্টি করে বাণিজ্যিকভাবে ঋণ বিতরণ করছে। লক্ষ্মীপুর জেলায় ক্ষুদ্রঋণ তদারকির জন্য প্রশাসনিক কোনো কমিটি নেই। এতে অবৈধভাবে গজিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা আদায় ও হয়রানি করছে।

জেলে সুরক্ষায় ‘অপর্যাপ্ত’ আইন

রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, এনজিওগুলোর হাত অনেক লম্বা। দাদনদাররাও প্রভাবশালী। তার ওপর প্রশাসনের নেই তদারকি। সব মিলিয়ে জেলেরা অসহায়।

চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লায় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সোপিরেট। অভিযোগ রয়েছে, লক্ষ্মীপুরে এই কাজে নিয়োজিত এনজিওগুলোতে প্রশাসনিক ঝামেলা এড়াতে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে সংস্থাটি।

গত ২২ অক্টোবর দুপুরে লক্ষ্মীপুর শহরের শেখ রাসেল সড়কে সোপিরেটের প্রকল্প প্রধান কার্যালয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির উপ-সমন্বয়কারী (অর্থ, প্রশাসন ও প্রোগ্রাম) মো. শরিফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুরে এমআরএর অনুমতি নিয়ে ৪০টি সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর বাইরেও অনেক অবৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চড়া সুদ আদায়, গ্রাহক হয়রানি রোধে অনুমোদনহীন সংস্থাগুলো শনাক্ত করতে আমরা চেষ্টা করছি।’

‘অবৈধ সংস্থা কয়টি এবং কী কী- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই।’

এ জেলায় ক্ষুদ্রঋণ তদারকি করার জন্য প্রশাসনিক কোনো কমিটি নেই। এই সুযোগে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছামতো টাকা আদায় ও হয়রানি করছে। জমা টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেলে প্রতারিত ব্যক্তিরা সমাজসেবা, সমবায় অফিসে আসেন। অথচ এখানে তাদের কোনো তথ্য নেই।- লক্ষ্মীপুর সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম পাটওয়ারী

এনজিও জেন্ডার অব এনভায়রমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সোসাইটির (জেমস) নির্বাহী পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী সোহাগ বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরে আমরা ছাড়াও ত্রিবেদি, সোপিরেট-এর ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের অনুমতি রয়েছে। প্রতি মাসেই আমরা এনজিও সমন্বয় কমিটির সভায় অবৈধভাবে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসা পরিচলনাকারীদের বিষয়টি উপস্থাপন করি। রায়পুরে এটি বেশি হয়। প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে আমরা অভিযান চালাবো।’

লক্ষ্মীপুর সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম পাটওয়ারী বলেন, এ জেলায় ক্ষুদ্রঋণ তদারকির জন্য প্রশাসনিক কোনো কমিটি নেই। এই সুযোগে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছামতো টাকা আদায় ও হয়রানি করছে। জমা টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেলে প্রতারিত ব্যক্তিরা সমাজসেবা, সমবায় অফিসে আসেন। অথচ এখানে তাদের কোনো তথ্য নেই।

জেলে সুরক্ষায় ‘অপর্যাপ্ত’ আইন

তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো জানিয়ে সমাজসেবার মহাপরিচালকের কাছে এক বছর আগে আমি একটি প্রস্তাবনা পাঠাই। এমআরএ ও পিকেএসএফ-এর সঙ্গে সমাজসেবা বিভাগের সমন্বয় করার জন্যও বলেছিলাম। কিন্তু কোনো সুফল আসেনি।’

লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জেপি দেওয়ান বলেন, ‘মাসিক এনজিও সমন্বয় কমিটির সভায় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বেআইনিভাবে যারা চড়া সুদের ব্যবসা করে, তাদের তালিকা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মানুষ যেন প্রতারিত না হয়, সেটিও নজর রাখা হবে।’

জনপ্রতিনিধি-প্রশাসনও অসহায়

রামগতির চর আবদুল্লাহ ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেন মঞ্জুর বলেন, ‘জেলেদের কাছে পাওনা টাকা লেনদেন নিয়ে হামলা-মামলার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। জেলের মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের কাছে পাওনা চেয়ে ইউনিয়ন পরিষদেও অভিযোগ আসে। পরিবারের সামর্থ্য থাকলে কিছু টাকা নিয়ে মিটমাট করে দিই। মহাজন, দাদনদারদের বিরুদ্ধে আমাদের কেন, প্রশাসনেরও কিছু করার নেই।’

লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি ও কমলনগর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুল্লাহ বলেন, ‘জেলেদের কষ্ট ও মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়টি আমি সংসদেও উপস্থাপন করেছিলাম। দাদন আর সুদ কারবারের সঙ্গে সরাসরি রাজনৈতিক নেতারা জড়িত। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও জেলেদের হয় না।’

জেলে সুরক্ষায় ‘অপর্যাপ্ত’ আইন

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আতিক উল্যা বলেন, জেলেরা দাদন প্রথার কাছে জিম্মি। তাদের সরকারি সহায়তা বলতে ভিজিএফ চালকেই বোঝায়। বিকল্প কর্মস্থানের জন্য এবার ১৬ জন জেলেকে বকনা গরু দেওয়া হয়, যদিও সেখানে নিবন্ধিত জেলে ৪ হাজার ৮৭২ জন।

লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন বলেন, জেলেদের দাদনের ঋণ কখনো পরিশোধ হয় না। আবার প্রত্যেকটি জেলে অধ্যুষিত এলাকায় পাওনাদারের ভয়ে জেলেদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও আছে। এ বিষয়ে কাজ করার আমাদের কোনো এখতিয়ার নেই।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত বা জলদস্যুর হামলায় যদি কোনো জেলে আহত বা নিহত হয়- তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের করা আবেদন আর্থিক সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত কমিটিতে পর্যালোচনা হয়। পরে সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার চেকের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা পায়। এজন্য জেলায় আর্থিক বরাদ্দ হয় না।

যা করণীয়

জেলেরা পেশা পরিবর্তন করতে চান না। তাদের অধিকার নিশ্চিত এবং স্বাবলম্বী করতে সরকারের করণীয় জানতে সাতটি জেলার শতাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলা হয়। বেশ কিছু সুপারিশ-পরামর্শ মিলেছে তাদের কাছ থেকে।

১. সরকারকে বিনা সুদে সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে জেলেদের। এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে জেলে-নৌকা-ট্রলারের সংখ্যা নির্ধারণ করে তার নিবন্ধন দেওয়া যেতে পারে। বাকি জেলেদের বিকল্প পেশায় পুনর্বাসন করা যেতে পারে।

২. চরগুলোতে বিপুল সরকারি খাসজমি রয়েছে। সেগুলো তালিকা করে জেলেদের বন্দোবস্ত দেওয়া যেতে পারে। এতে ওই জমিতে বসবাসের পাশাপাশি ফসল উৎপাদন থেকে আয়ও তাদের জন্য সহায়ক হবে।

৩. মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়ে বাস্তবসম্মত প্রণোদনা দিতে হবে।

৪. মৎস্য আইন ও নীতিমালার কোথাও ‘জেলে’ শব্দটি নেই। সেখানে ‘মৎস্যজীবী লেখা রয়েছে। আইন-নীতিমালায় ‘জেলে’ উল্লেখ করতে হবে।

জেলে সুরক্ষায় ‘অপর্যাপ্ত’ আইন

৫. ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ বংশ বিস্তার স্বাভাবিক রাখতে নদ-নদী দূষণমুক্ত করার পাশাপাশি ডুবোচরগুলোতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিয়মিত খনন কাজ চালাতে হবে।

৬. জেলের ছেলে জেলেই হতে হবে, অন্য কিছু করার সুযোগ নেই- এ ধারণা বদলে সময়োপযোগী প্রশিক্ষণসহ বিকল্প কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।

৭. জেলে মারা যাওয়ার পর তার কোনো সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তার পরিবারকে প্রণোদনা দিতে হবে এবং সে প্রাপ্তবয়স্ক হলেই নিবন্ধন করতে হবে।

৮. নদী-সমুদ্রে প্রশাসনের হয়রানি রোধ এবং জেলেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

৯. উপকূলজুড়ে এনজিও-দাদনদারদের অপতৎপরতা রোধে প্রশাসনকে কার্যকর তদারকি করতে হবে। তাহলে প্রান্তিক জেলেরাও সুফল পাবেন।

এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।