মাদারীপুরে হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা, তবে ইজারা বাতিল

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি মাদারীপুর
প্রকাশিত: ০২:৫৮ পিএম, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

মাদারীপুরের কালকিনিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা। তবে মেলা সংলগ্ন এলাকায় এখনো মেলা বন্ধের ব্যানার ঝুলছে। এতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যে মেলা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশার।

এদিকে গত দুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে মেলা বন্ধের খবরটি। ফলে পুরো জেলা জুড়ে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বছরের কুন্ডুবাড়ির মেলাটি ৩১ অক্টোবর থেকে পাঁচদিনের জন্য হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) সকাল থেকে মেলা সংলগ্ন সড়কের মোড়ে মোড়ে ব্যানার ঝুলতে দেখা যায়। তাতে লেখা- ‘ এবছর (২০২৪) সাল থেকে কুন্ডুবাড়ির মেলা স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হলো। বাস্তবায়নে সর্বস্তরের জনগণ।’

এরপর সেই ব্যানারের ছবিসহ মেলা বন্ধের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় সমালোচনার ঝড়।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, প্রতিবছর কালীপূজাকে ঘিরে মাদারীপুরের কালকিনির ভুরঘাটা এলাকার ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশেই অনুষ্ঠিত হয় এই কুন্ডুবাড়ির মেলা। মেলাকে ঘিরে বেশ কয়েকদিন আগে থেকে শুরু হয় সাজ সাজ রব। তৈরি হয় তোড়ন, লাইটিংসহ নানা কিছু। কিন্তু এবার সেই চিত্র দেখা না যাওয়া ও মেলা বন্ধের ব্যানার দেখে ব্যবসায়ীসহ জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর মেলায় মারামারি হয়, বিগত বছরে খুন পর্যন্ত হয়েছে। মেলায় জুয়ার আসর বসানো হয়। মদ-গাজার আড্ডা হয়। চাঁদাবাজি হয়। ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। যানজট দেখা দেয়। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতির কারণে এলাকার জনগণ ভিত।’ এমন নানা অভিযোগ তুলে স্থায়ীভাবে মেলা বন্ধের জন্য আলেম সমাজ কালকিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে একটি দরখাস্ত দেন।

এছাড়া প্রতিবছর কালকিনি পৌরসভা থেকে দরপত্র আহ্বান করে নিয়োগ দেওয়া হয় ঠিকাদার। এবারও পরিচালনার কাজটি পান স্থানীয় আকবর মাদবর নামের এক ব্যক্তি। এরইমধ্যে বাতিল করা হয় মেলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেওয়া ইজারাদার। তবে শনিবার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মিটিং করে সীমিত আকারে মেলা চালুর কথা জানায় কালকিনি উপজেলা প্রশাসন।

গোপালগঞ্জ থেকে আসা ফার্নিচার ব্যবসায়ী জয়নাল হোসেন বলেন, আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে এই মেলায় এসে ফার্নিচার বিক্রি করি। আমার বাবাও বিক্রি করেছেন। এ বছরও করবো বলে অনেক আগে থেকে নানা ফার্নিচার তৈরি করেছি। মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ফার্নিচারের কাজ করেছি। এখন একবার শুনছি মেলা হবে, আবার শুনছি মেলা হবে না। আমরা তো দোটানার মধ্যে পড়ে গেলাম। আর মেলা যদি না হয়, তাহলে বড় লোকসানের মধ্যে পড়ে যেতে হবে।

ঢাকা থেকে আসা আরেক ফার্নিচার ব্যবসায়ী ছালাম বেপারী বলেন, ইতিমধ্যে আমরা মালামাল আনার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ মেলার বন্ধের ব্যানার দেখে হতাশায় পড়ে গেছি। মেলা না হলে এতদিনের তৈরি করা মালামাল নিয়ে বিপদে পড়ে যাবো।

স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, কুন্ডুবাড়ির মেলা আমাদের ২০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। এটা বন্ধ হলে আমাদের ঐতিহ্য বিলিন হয়ে যাবে। তাই এই ঐতিহ্য কিছুতেই বন্ধ করতে দেওয়া যাবে না।

স্থানীয় শহিদুল ইসলাম বলেন, কাঠের বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্রের জন্য এই মেলা বিখ্যাত। মূলত মেলায় কাঠের আসবাবপত্রই বেশি বিক্রি হয়। মাদারীপুর ছাড়াও ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, মাগুরা, যশোর, নড়াইল, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা তাদের মাটির, বাঁশের ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন মালামাল বিক্রির জন্য এই মেলায় নিয়ে আসেন।

jagonews24

মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস বলেন, দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী এই কুন্ডুবাড়ির মেলা। মেলা আমাদের ঐতিহ্য। এটা কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না। সেই ছোটবেলা থেকেই মেলা দেখে আসছি। মেলাটি কুন্ডুবাড়ির মেলা নামে পরিচিত। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাঠের আসবাবপত্রের সমারোহ ঘটে এই মেলায়। এতে মাদারীপুরসহ বৃহত্তর ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল জেলার বিভিন্নস্থান থেকে হাজার হাজার লোকের ঢল নামে।

তিনি আরও বলেন, কালকিনি পৌর এলাকার ভুরঘাটার গোপালপুরের কুন্ডুবাড়িতে ১৭৮৩ সালের নভেম্বরে দ্বীপাবলী ও শ্রী শ্রী কালীপূজা উপলক্ষে দীন নাথ কুন্ডু ও মহেশ কুন্ডু এই মেলার প্রবর্তন করেন। তাই কুন্ডুদের বংশের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় কুন্ডবাড়ির মেলা।

কুন্ডুবাড়ির কালি মন্দির কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি স্বপন কুন্ডু বলেন, কে বা কারা মেলা বন্ধের ব্যানার টানিয়েছে তা আমাদের জানা নেই। তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে, এবার তারাই মেলা পরিচালনা করবে। এটা নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরা চাই সবাই সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান উদযাপন করতে। মৌখিকভাবে মেলা পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হলেও এখনো কাগজ হাতে পাইনি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় আলেম ইমামুল ইসলাম বলেন, মেলাকে ঘিরে নানা অসামাজিক কর্মকাণ্ডের কারণেই আপত্তি রয়েছে। এ জন্য উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে বিষয়টি জানানো হয়েছে। বিষয়টি প্রশাসন ভেবে দেখবে। তবে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা করতে কোনো অসুবিধা নেই।

কুন্ডুবাড়ির মেলা পরিচালনা ইজারাদার আকবর মাদবর বলেন, একবার বলে মেলা হবে, আবার বলে হবে না। মেলা পরিচালনার জন্য পৌরসভা থেকে আমাকে ইজারাও দেওয়া হয়। সেই ইজারার নির্ধারিত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমাও দিয়েছি। এখন পৌরসভা থেকে বলা হচ্ছে ইজারা বাতিল করা হবে। তাহলে আমি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবো।

কালকিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) উত্তম কুমার দাশ বলেন, কুন্ডুবাড়ির মেলা ও পূজা হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ বছর ধরে। এটি বেশ পুরনো ঐতিহ্য। পূজা হওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা বা জটিলতা নেই। তবে, মেলা হওয়া নিয়ে আলেম সমাজ বেশ কয়েকটি অভিযোগ করে। এতে ইজারা বাতিল করে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে মেলা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জেলা প্রশাসকের নির্দেশক্রমে মেলা পরিচালনা করা হবে। আশা করছি, বৃহস্পতিবার থেকে তিনদিন চলবে মেলা।

আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/জেডএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।