১৮ বছরেও চালু হয়নি বগুড়ার ৩ হাসপাতাল

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ১০:৫৫ এএম, ২১ অক্টোবর ২০২৪

রোববার সকাল ১০টা। সান্তাহার ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের গেটে ঝুলছে বিশাল আকৃতির একটি তালা। ছাই রঙের লোহার গেটের নিচ ও ওপর দিয়ে উকিঝুঁকি মেরেও ভেতরে কোনো মানুষের সাড়া মিললো না। অথচ এই সময়ে বহির্বিভাগে রোগী দেখা কার্যক্রম চালু থাকার কথা।

বগুড়া সিভিল সার্জন অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো নানা জটিলতায় এই হাসপাতালে বিগত ১৮ বছরে আন্তঃবিভাগ (ইনডোর সার্ভিস) চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে বহির্বিভাগ চলে নিয়মিত। ছুটির দিন ব্যতীত নিয়মিত রোগী দেখা হয়। ওষুধ দেওয়া হয়। এজন্য বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও সহকারীও নিয়োগ করা হয়েছে।

তবে সেই তথ্য যাচাই করতে গিয়ে বাস্তবে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। কাগজে কলমে দায়িত্বরত হিসেবে আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. ফাহমিদা হরকিলের নাম থাকলেও তাকে কখনো দেখেননি এলাকার মানুষ। অন্যান্য পদের মধ্যে ৫ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স, ১ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ১ জন ফার্মাসিস্ট ও একজন ওয়ার্ডবয় সেখানে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও তারা হাসপাতালে আসেন না। ফার্মাসিস্ট আবুল বাসার মাঝেমধ্যে নিজের সুবিধামতো রোগী দেখে ওষুধ দেন। তবে পরিদর্শনকালে তাকেও পাওয়া যায়নি।

আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. ফাহমিদা হরকিলকে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।

১৮ বছরেও চালু হয়নি বগুড়ার ৩ হাসপাতাল

সান্তাহারের মতো বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও শিবগঞ্জের আলিয়ারহাটের আরও ২টি হাসপাতালে গত এক সপ্তাহ ধরে টানা অনুসন্ধান চালানো হয়। সেখানেও এই চিত্রের পুনরাবৃত্তি মেলে। নানা জটিলতায় এই হাসপাতালগুলোতেও দেড় যুগ ধরে রোগী ভর্তি কার্যক্রম চালু করা যায়নি।

সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা যায়, আধুনিক নির্মাণশৈলীতে তৈরি করা ভবনগুলো ধীরে ধীরে হচ্ছে পরিত্যক্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত। দেওয়ালে জন্মছে আগাছা, ফেটে গেছে পলেস্তারা। শ্যাওলার আবরণ ঢেকে ফেলেছে রঙ। বছরের পর বছর ধরে অবহেলা যেন সইতে পারছে না অবকাঠামোগুলো। হাতের কাছে সুদৃশ্য ভবনসহ হাসপাতাল থাকার পরও সুচিকিৎসার জন্য এলাকার মানুষকে প্রতিনিয়ত ছুটতে হচ্ছে শহরে।

চিকিৎসা চলে কাগজে-কলমে

সান্তাহারের বাসিন্দা আমিনুল হক বলেন, এই হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সসহ ৯ জন স্টাফের কথা বলে বেতন-ভাতাদি উত্তোলন করা হলেও এখানে কোনো ডাক্তার আসেন না। দুই-একজন রোগী এলেও চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যান।

ব্যবসায়ী হাকিম মন্ডল বলেন, এই এলাকায় কোনো ক্লিনিকে এমবিবিএস ডাক্তার রোগী দেখেন না। সরকারি হাসপাতালও নেই। যার কারণে এলাকার রোগীরা সরকারি এবং বেসরকারি উভয় চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত।

১৮ বছরেও চালু হয়নি বগুড়ার ৩ হাসপাতাল

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সান্তাহার পৌরসভাসহ আশপাশের লক্ষাধিক মানুষের জন্য শহরে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতাল নেই। অসুস্থ হলে এই এলাকার মানুষকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে নওগাঁ সদর হাসপাতাল অথবা আট কিলোমিটার দূরে আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়। এই বিবেচনাতেই রথবাড়ি এলাকার ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। কাগজ-কলমে এই হাসপাতালে ২৪ জন জনবলের মধ্যে ৯ জন নিয়োগপ্রাপ্ত রয়েছে। তবে তারা সংযুক্তিতে অন্যত্র কাজ করেন।

জেলা স্বাস্থ্য প্রকৌশল সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের শাসনামলে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৩ কোটি ৩৩ লাখ ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে এই হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগনে শাহরিন ইসলাম তুহিনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি পায়। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ না করেই ঠিকাদার বিল তুলে কাজ বন্ধ করে দেন। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে কর্তৃপক্ষ নজর না দেওয়ায় হাসপাতালটি পরিত্যক্ত অবস্থায় মাদকসেবীর আখড়ায় পরিণত হয়।

২০১৯ সালে একই মন্ত্রণালয় পুনরায় ৩ কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকায় হাসপাতালের স্টাফ কোয়ার্টারসহ অবশিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু করে ২০২১ সালে শেষ করে। এরপর ৩ বছর পার হলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি।

হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কাগজকলমে ৯ জনবল নিয়োগ দেওয়া হলেও সেখানে ডাক্তার-নার্স কেউই দায়িত্ব পালন করেন না। ডাক্তার না থাকায় কোনো রোগীও আসে না। মাঝে মধ্যে গেট খুলে বসে থাকেন ফার্মাসিস্ট আবুল বাশার। তিনি কেউ চাইলে ২-১টি করে ওষুধ দেন। সেখানে ১ জন ডাক্তারসহ ৯ জন কর্মরত থাকলেও কাজ না থাকায় তাদের আদমদীঘি উপজেলা ৫০ শয্যা হাসপাতালে সংযুক্ত করে রাখা হয়েছে।

এই হাসপাতালে ইনডোর চিকিৎসাসেবা চালু করতে হলে প্রয়োজনীয় ডাক্তার-নার্সসহ মঞ্জুরিকৃত জনবল, অপারেশন, এক্স-রে মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি পরীক্ষার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, রোগীদের বিছানাপত্র, অন্যান্য আসবাব ও অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে সিভিল সার্জন অফিস থেকে চাহিদাপত্র সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।

ফার্মাসিস্টের প্রেসক্রিপশনেই ভরসা

২০০২ সালে বগুড়ার নন্দীগ্রামে ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণ কাজ শেষে উদ্বোধন করা হয় ২০০৬ সালে। এরপর যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হলেও ১৮ বছর ধরে চালু করা হয়নি এই হাসপাতাল। এই হাসপাতাল নির্মাণে সেসময় মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ২৬ লাখ ৭৩ হাজার ১৬৮ টাকা।

২০০৮ সালে হাসপাতালের জন্য ২৪টি পদ সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে এখানে কাগজে কলমে একজন আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও), ১ জন মেডিকেল কনসালটেন্ট, ১ জন মেডিকেল কর্মকর্তা, ৫ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স, ১ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ১ জন ফার্মাসিস্ট ও ১ জন ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট রয়েছেন।

সরেজমিন নন্দীগ্রামের হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটক আর নিচতলার কয়েকটি কক্ষ খোলা রয়েছে। ভূতুড়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় দেখা যায় হাসপাতালে কোনো বিছানা ও আসবাবপত্র নেই। নেই বৈদ্যুতিক বাতি। ভবনের দরজা-জানালায় ঘুন ধরে ভেঙে পড়ার উপক্রম। অনেক দরজা-জানালার কপাট খুলে পড়ছে। মেঝেতে ধুলা ও দেওয়ালে শেওলা ধরেছে। অপারেশন থিয়েটারে পড়ে আছে ভাঙা যন্ত্রপাতি। পাশেই জড়ো করে রাখা ময়লার স্তূপ।

১৮ বছরেও চালু হয়নি বগুড়ার ৩ হাসপাতাল

ফার্মাসিস্ট সোহেল হায়দার জানান, তিনি সরবরাহ অনুসারে কিছু ওষুধপত্র রোগীদের ফ্রিতে সরবরাহ করেন। কোন রোগের কোন ওষুধ তা তিনি মুখস্ত করে ফেলেছেন।

চিকিৎসক ফারজানা পারভিন বলেন, তিনি নিয়মিত বহির্বিভাগে রোগী দেখে ব্যবস্থাপত্র দেন। আর সুযোগ না থাকায় ভর্তি কিংবা অপারেশন করার পরিস্থিতিতে কোনো রোগী এলে তাদেরকে জেলা সদরে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. একেএম সাহিনুর হাসানের মোবাইলে কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

আরএমও থাকেন ২০ কিলোমিটার দূরে

শিবগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৮ বছর আগে নির্মাণ হয় ২০ শয্যা বিশিষ্ট আলিয়ারহাট হাসপাতাল। কর্তৃপক্ষ বলছে, কোনো প্রকার বরাদ্দ ও প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগের অনুমতি না পাওয়ায় চালু করা সম্ভব হচ্ছে না হাসপাতালটি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সেখানে রোগী ভর্তি শুরু না হলেও ১১ জনের একটি টিম (জনবল) রয়েছে।

২০০৫ সালে শিবগঞ্জ বন্দর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে এই হাসপাতাল নির্মিত হয়। এতে ব্যয় হয় চার কোটি ৩২ লাখ টাকা। প্রথমে আধুনিক অপারেশন থিয়েটারসহ চিকিৎসা সেবার অনেক যন্ত্রপাতিই স্থাপন করা হয় হাসপাতালটিতে। কিন্তু সেবা চালু করা হয়নি। বর্তমানে এই হাসপাতালে একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার, ৩ জন মেডিকেল অফিসার, ৫ জন স্টাফ নার্স, ১ জন ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট ও একজন ওয়ার্ডবয় নিয়োগপ্রাপ্ত রয়েছেন।

দাবি করা হচ্ছে সেখানে বহির্বিভাগে ১ জন উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার রোগিদের স্বাস্থ্যসেবা দেন। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বরাদ্দ সাপেক্ষে ওষুধও সরবরাহ করা হয়।

তবে এলাকার বাসিন্দা আমীর হামজা বলেন, বর্তমানে জ্বর, সর্দি, কাশির মতো সাধারণ রোগের পরামর্শ সেখানে দেয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসার যন্ত্রপাতি শিবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থানান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে আলিয়ার হাট হাসপাতালের নামে কোনো ওষুধের বরাদ্দ নেই। শিবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কিছু ওষুধ দেয়, সেটা থেকে অল্প পরিমাণ রোগীদের দেওয়া হয়।

আলিয়ারহাট হাসপাতালের আরএমও ডা. সুতনু রায় থাকেন ২০ কিলোমিটার দূরে মোকামতলায়।

তিনি বলেন, সেখানে কিছু লোকবল নিয়োগ করা হয়েছিল শুরুতে। কিন্তু প্রয়োজনীয় ওষুধ বরাদ্দ ও পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় হাসপাতালটি চালু করা সম্ভব হয়নি। পরে নিয়োগকৃত চিকিৎসকদের স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে হাসপাতালটি চালুর ব্যাপারে দাপ্তরিক কাজ চলছে।

একজন উপ-সহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা ও একজন ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। তারা আউটডোরে চিকিৎসাসেবা দেন। হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন থাকার পাশাপাশি একজন নিরাপত্তাকর্মীও রয়েছেন। তবে এখানেও পূর্ণাঙ্গ সেবা দেওয়া হয় না। জটিল কোনো রোগের জন্য জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে পাঠানো হয়।

বগুড়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শফিউল আজম জানান, ২০ শয্যার তিনটি হাসপাতালের বহির্বিভাগ পুরোদমে চালু রয়েছে। সেখানে ছুটির দিন ব্যতীত সবদিনই সেবা দেওয়া হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গভাবে আন্তর্বিভাগ চালু করতে জনবল ও অন্যান্য বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এখন বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে সেখানে কর্মরত অনেকে সংযুক্তি নিয়ে অন্য হাসপাতালে কাজ করছেন।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।