যমুনার চরে চরমপন্থিদের উৎপাত, আতঙ্কে বাড়ি ছাড়ছে মানুষ
মানিকগঞ্জের শিবালয়ে যমুনা নদীর দুর্গম শুকুলিয়া চরে চরমপন্থিদের ভয়ে বাড়ি-ঘর ছাড়ছে মানুষ। ২৫-৩০ জনের সশস্ত্র একটি গ্রুপ প্রায় প্রতিদিনই হানা দিচ্ছে চরে। চাঁদা না দিলে দেওয়া হচ্ছে হত্যার হুমকি। ফলে প্রাণভয়ে অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন। চরজুড়ে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা।
সরেজমিনে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই চরমপন্থি দলটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
মানিকগঞ্জ পুলিশ সুপার মো. বশির আহমেদ জানান, চরাঞ্চলে পুলিশি টহল বাড়ানোর পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, তেওতা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের আলোকদিয়া চরের শুকুলিয়া এলাকায় দেড় শতাধিক মানুষের বসবাস। এক পাশে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা। অন্যপাশে পাবনা জেলার আমিনপুর। বিশাল এই চরটি অনেক সম্ভাবনাময়। গত বছর থেকেই এই চরে পাবনার একটি চরমপন্থি গ্রুপ মাঝে মধ্যে হানা দিতো। তারা জেলেদের কাছ থেকে প্রায়ই চাঁদা নিতো। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
পাবনার চরমপন্থি নেতা জুলহাসের নেতৃত্বে ২৫-৩০ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ প্রায় প্রতিদিনই শুকুলিয়া চরে হানা দিচ্ছে। তারা প্রথমে ওই চরের মাতবরের কাছে বাড়ি প্রতি ৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। মাতবর দিতে রাজি না হলে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
এরপর মাতবর ভয়ে তাদের ৫০ হাজার টাকা দেন। কিন্তু তারপরও বন্ধ হয়নি জুলুম-অত্যাচার। পুনরায় চাঁদা দাবি করা হয়েছে ৫ লাখ টাকা। না দিলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এরপরই বাড়ি ঘরে তালা দিয়ে গবাদি পশু ও পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রাম ছাড়ছেন বাসিন্দারা।
ভুক্তভোগী এক নারী জানান, চরমপন্থি দলের সবার হাতেই ছোট বড় আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। তারা অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখায়। তাদের খাওয়ার জন্য ভাত-খিচুড়ি রান্না করে দিতে হয়। অনেক সময় সারাদিন, অনেক দিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পযর্ন্ত অবস্থান করে চরে। বউ-মেয়ে নিয়ে খুবই নিরাপত্তাহীনতাই থাকতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় চলে এসেছি। এখানে থাকতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কী করবো, জানে তো বাঁচতে পারবো।
আরেক নারী বলেন, আমার ১২ বছরের ছেলেকে তুলে নিতে চেয়েছিল। এরপর আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখানো হয়। পরদিনই পালিয়ে এসেছি এলাকা থেকে। বাড়িঘর ছেড়ে আছি। খুব মায়া লাগছে। কষ্ট হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, শুকুলিয়া চরটি দুর্গম হওয়ায় চরমপন্থি দলটির জন্য নিরাপদ। এ কারণে এ চরে আস্তানা গড়তে চায় তারা। চাঁদা না দিলে ফসলের মাঠে যেতেও বাঁধা দেওয়া হয়। কয়েকদিন আগে ক্ষেতে হালচাষের সময় এক ট্রাক্টর চালককে বেধড়ক মারপিট করা হয়েছে। বাধা দেওয়া হয় নদীতে মাছ ধরতেও।
আলোকদিয়া চরের এক জনপ্রতিনিধি জানান, চরে ঢোকার আগে সর্বহারা দলটি ফাঁকা গুলি ছুড়ে এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করে। তাদের ভয়ে আশপাশের চরের মানুষও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দ্রুত প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।
মানিকগঞ্জ পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদন্নতিপ্রাপ্ত) মো. বশির আহমেদ জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। তারা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছে। পাবনার আমিনপুর এলাকার একটি গ্রুপ চরের মানুষকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মূলত চরের একটি কূল দখলকে কেন্দ্র করে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই গ্রুপের লিডার জুলহাসসহ কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাড়ানো হবে পুলিশি টহলও।
বছর পাঁচেক আগে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৭ জেলার প্রায় ৬ শতাধিক চরমপন্থি তৎকালীন স্বরাষ্টমন্ত্রীর কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এরপর থেকে পাবনা, কুষ্টিয়া ও সিরাজগঞ্জ এলাকার চরমপন্থিদের আনাগোনা বন্ধ ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই কয়েকটি গ্রুপ আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
বি.এম খোরশেদ/এফএ/এমএস