টানা ১৪ বছর ‘স্বঘোষিত’ এমপি ছিলেন সাজেদার দুই ছেলে, দেখাতেন দাপট
মায়ের ক্ষমতাবলে টানা ১৪ বছর ফরিদপুর-২ আসনের অনেকটা ‘স্বঘোষিত’ এমপি ছিলেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেত্রী সাবেক এমপি প্রয়াত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর বড় ছেলে আয়মন আকবর বাবলু চৌধুরী ও ছোট ছেলে শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী। এমপির মতোই ক্ষমতার চর্চা করতেন তারা। এ সুযোগে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন এই দুই ভাই।
টানা ১০ বছর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও নানা দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বাবলু চৌধুরী। একপর্যায়ে জনরোষে বাবলু চৌধুরী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলে তার জায়গা দখলে নেন ছোট ভাই লাবু চৌধুরী। জনস্বার্থে তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮ সালের পর থেকে বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে পড়েন ফরিদপুর-২ (সালথা-নগরকান্দা) আসনের বারবার নির্বাচিত এমপি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তিনি অসুস্থ থাকলেও এ আসনে ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা এমপি ছিলেন। তবে অসুস্থতার কারণে নিজ নির্বাচনীয় এলাকায় তেমন সময় দিতে পারতেন না। এ অবস্থায় প্রথমে তার বড় ছেলে বাবলু চৌধুরীকে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনীয় এলাকা দেখভালের দায়িত্ব দেন।
দায়িত্ব নিয়েই বাবলু চৌধুরী তার মায়ের নির্বাচনী এলাকায় রাম রাজত্ব শুরু করেন। অসুস্থ মায়ের চেয়ার দখলে নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সালথা ও নগরকান্দা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। এ পুরো সময়টা নানা অপকর্মে লিপ্ত হন বাবলু চৌধুরী। স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দিয়ে গঠন করেন ‘মামা বাহিনী’ নামে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী। ওই বাহিনী দিয়ে নিজ দলীয় ও বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের পর নির্মম নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতো। কেউ তার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করলে হাতুড়িপেটা করে তার হাত-পা ভেঙে পঙ্গু করে দিতেন।
বাবলুর হাত থেকে রেহাই পাননি স্থানীয় সাংবাদিকরাও। সালথা প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতি সেলিম মোল্যা ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নাহিদের ওপরও নির্যাতন করা হয়। মামলা দিয়ে টানা তিন বছর এলাকা ছাড়া করে রাখা হয় তাদের। স্থানীয় সাংবাদিক আবু নাসের হুসাইন ও এমকিউ বুলবুলের ওপরও হামলা করে এই মামা বাহিনী।
মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়েও ক্ষ্যান্ত হননি বাবলু চৌধুরী। অভিযোগ রয়েছে, টানা ১০ বছর মায়ের ক্ষমতাবলে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি দপ্তর থেকে কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, টিআর-কাবিখা ও ত্রাণের প্রকল্প হরিলুট করে শতশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বাবলু চৌধুরী। তাছাড়া ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য করে বিপুল পরিমাণে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এমনকি অসুস্থ মা সাজেদা চৌধুরীর বেতন-ভাতাসহ নানা সরকারি সুবিধার অর্থ উত্তোলন করে নিয়ে নিতেন তিনি। এভাবে দুর্নীতি করে ঢাকার বনানীতে করেছেন আটতলা আলিশান বাড়ি।
বাবলু চৌধুরীর জুলুম-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১৮ সালে নিজ দলের নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে মাঠে করেন। একপর্যায় তিনি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরে তার জায়গা দখলে নেন ছোট ভাই শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী। তবে তিনিও মায়ের নির্বাচনীয় এলাকা দেখভালের দায়িত্ব পেয়ে বসে ছিলেন না। ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মায়ের ক্ষমতাবলে ‘স্বঘোষিত এমপি’ ছিলেন তিনি। তবে ২০২২ সালে ১১ সেপ্টেম্বর সাজেদা চৌধুরী মারা যাওয়ার পর উপনির্বাচনে লাবু চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হন।
এরপর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে আবারও এমপি নির্বাচিত হন লাবু চৌধুরী। তবে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পর তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ভাইয়ের মতো তিনিও টানা ৫-৬ বছর সালথা-নগরকান্দার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। যে কারণে তারও সম্পদের অভাব নেই। লাবু চৌধুরীর ঢাকার ধানমন্ডিতে দুটি ফ্ল্যাট, উত্তরায় ৮ কাঠাসহ জমি, বিদেশে বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদক রয়েছে বলে জানা গেছে। সচেতন মহলের দাবি, বর্তমান সরকার যদি তাদের দুই ভাইয়ের সম্পদের অনুসন্ধান করে, তাহলে সবকিছু বেরিয়ে আসবে।
সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মিয়া বলেন, ‘সাজেদা চৌধুরীর দুই ছেলে ১৪টি বছর সালথা ও নগরকান্দায় অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। আমার বড় ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন মিয়া ও আমার ওপর সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছে তারা দুই ভাই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দলীয় লোক হওয়ার পরও অন্তত মিথ্যা ১০টি মামলা দিয়েছে আমাদের নামে। জনসমাবেশে সাজেদা চৌধুরীর উপস্থিততে আমার বড় ভাইকে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করেছে তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী। এরপর তাকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। তিনি এক বছর জেল খেটে বের হন। এছাড়া আমাদের বাড়ি ও মার্কেটে হামলা হয়েছে তাদের দুই ভাইয়ের নির্দেশে। তারা অসুস্থ মাকে পুঁজি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছেন।
নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত আলী শরিফ বলেন, ‘এমপি না হয়েও তারা মায়ের ক্ষমতাবলে দীর্ঘ ১৪টি বছর সালথা ও নগরকান্দার মানুষকে শাসন করেছেন। মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেছেন। বিশেষ করে বিএনপির শত শত নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করে রেখেছেন বছরের পর বছর। পাশাপাশি দুর্নীতি-অনিয়ম করে বিপুল সম্পদ বানিয়েছেন। তাদের দুই ভাইয়ের অবৈধ সব সম্পদ জব্দ করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই।’
সোমবার (১৪ অক্টোবর) দুপুরে কথা হয় সালথা উপজেলা বিএনপির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান তালুকদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সাজেদা চৌধুরীর দুই ছেলে সালথা ও নগরকান্দাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। মামা বাহিনী দিয়ে জনগণের ওপর এমন কোনো অত্যাচার নেই যা তারা দুই ভাই করেনি। আমার বিরুদ্ধেও এ পর্যন্ত ২৯টি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমি আজকেও হাজিরা দিতে কোর্টে এসেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারা দুই ভাই এ আসনে জনগণের জন্য রাজনীতি করতে আসেনি। তারা এসেছিল মায়ের ক্ষমতা খাটিয়ে লুটপাট করতে। তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে।’
এসব অভিযোগের বিষয় বক্তব্য নেওয়ার জন্য সাজেদা চৌধুরী বড় ছেলে আয়মন আকবর বাবলু চৌধুরী ও শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। এমনকি তাদের ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
এন কে বি নয়ন/এসআর/জিকেএস