নোয়াখালীতে পুলিশ হত্যায় গ্রেফতাররা সমন্বয়ক নয়: সারজিস আলম
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে পুলিশ হত্যায় গ্রেফতার এক কিশোর ও দুই তরুণ সমন্বয়ক নয় বরং রেগুলার আন্দোলনকারীও ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আলোচিত সমন্বয়ক সারজিস আলম। রোববার (১৩ অক্টোবর) রাতে নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্টে এমন দাবি করেন তিনি।
এর আগে শনিবার (১২ অক্টোবর) নোয়াখালী পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল ফারুক ওই তিনজনেকে গ্রেফতারের তথ্য নিশ্চিত করেন।
এতে বলা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ৫ আগস্ট নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানা পুলিশের এক কনস্টেবলকে হত্যার অভিযোগে এক কিশোর ও দুই তরুণকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মন্তব্য ছড়িয়ে পড়ে।
ফেসবুক পোস্টে সারজিস আলম লিখেছেন, ‘প্রথমেই যখন শুনলাম নোয়াখালীতে পুলিশ হত্যা মামলায় ৩ জন কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তখনই নোয়াখালী জেলার একাধিক সমন্বয়ক, আন্দোলনকারী এবং জেলা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি৷ নোয়াখালীর মেইন আন্দোলন হয়েছে মাইজদীতে। সমন্বয়কদের ভাষ্য অনুযায়ী মাইজদীতে গুলি চলেনি ৷ যে ৫ জন শহীদ হয়েছেন তারা সোনাইমুড়ী উপজেলার এবং সেখানেই শহীদ হয়েছেন।
৫ তারিখে হাসিনা সরকারের পতনের পর বিকেল প্রায় ৪টার দিকে সোনাইমুড়ী থেকে বিজয় মিছিল বের হয়৷ যারা এতদিন ধরে আন্দোলন করেছে তাদের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণভাবে তাদের আন্দোলনের ক্ষেত্র মাইজদীতে যাওয়া৷ এর মধ্যে কিছু অতিউৎসাহী মানুষ সোনাইমুড়ী থানার দিকে অগ্রসর হয়। তারা থানার ভেতরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আছে, এই তথ্যের ভিত্তিতে থানায় প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ মাইক দিয়ে থানার ভেতরে না আসার জন্য ঘোষণা করে।
কিন্তু মানুষ তারপরও থানার ভেতরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করে। তখন পুলিশ গুলি ছুড়লে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয় এবং তাদের একজন ওই স্থানেই মারা যায়। এরপর শুরু হয় অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি, হামলা, পাল্টাহামলা। মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
তখন জনতার ভেতর থেকে কিছু সুযোগসন্ধানী ভিন্ন উদ্দেশ্যের লোক থানার অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করে, পুলিশের দিকে গুলি ছোড়ে এবং একজন কনস্টেবলকে পিটিয়ে হত্যা করে। এতে মোট দুইজন পুলিশ সদস্য এবং তাদের একজন চালক নিহত হন। কিছু পথচারী উৎসুক কিশোরও গুলিবিদ্ধ হয়।
যে তিনজন ছেলেকে গ্রেফতার নিয়ে কথা হচ্ছে তাদেরকে গ্রেফতার করার মূল কারণ ছিল তাদের মধ্যে একজন সেদিনের লুট করা অবৈধ অস্ত্রসহ টিকটকে পোস্ট দেয় ভাব নেওয়ার জন্য। সেই ছবি দেখে স্থানীয় জনতাসহ অনেকেই পুলিশকে অবহিত করে এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয় ৷ জিজ্ঞাসাবাদে সেই ছেলে আরও দুজনের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করে এবং এক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার বিভিন্ন এভিডেন্স তাদের কথায় ও ফোন ম্যাসেজিংয়ে পায়৷
এখন পর্যন্ত নোয়াখালীতে ২৯টি লুটকৃত অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি ৷ যেগুলোর মধ্যে রয়েছে চায়না রাইফেল, পিস্তল, শর্টগান ইত্যাদি ৷ যেগুলো নিয়ে জনমানুষের মধ্যেও ভীতি আছে।
উল্লেখ্য একাধিক স্থানীয় আন্দোলনকারী ও সমন্বয়কের মাধ্যমে জানতে পারি গ্রেফতাররা সমন্বয়ক তো নয়ই বরং রেগুলার আন্দোলনকারীও ছিল না ৷ ওই ছেলেগুলোকে চেনে, এলাকার এমন সমবয়সীরা সেটা নিশ্চিত করেছে ৷ তারা স্থানীয় একটি কিশোর গ্যাং 'বুলেট গ্যাং' এর সদস্য ৷ তাদের ফেসবুক প্রোফাইল ঘাটলেও নামের সামনে ‘বুলেট’ ট্যাগ দেখা যায় ৷
পাশাপাশি ৫ তারিখের পূর্বে ও পরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের উৎপাত এবং সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়৷ এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেউ যদি আন্দোলনকারী বা সমন্বয়কের নাম ভাঙিয়ে কোনো অন্যায় কাজে লিপ্ত হয় তাহলে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যাবে কি না? উত্তর হচ্ছে অবশ্যই আনতে হবে৷ পাশাপাশি বিভিন্ন গুজবে বা তদবিরে কোনো অন্যায়কারী যেন ছাড়া না পায় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
পরবর্তীতে তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওই তিনজনের মধ্যে দুইজনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং একজনকে লঘুভাবে জড়িত থাকার কারণে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে৷
উল্লেখ্য জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতার বিভিন্ন মামলায় এখন পর্যন্ত নোয়াখালীতে আটজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
এবার যদি পুলিশের বিষয়ে বলি৷ অপরাধীদের আপনারা আইনের আওতায় আনবেন অবশ্যই৷ তবে যে পুলিশ সদস্যরা নিজে অন্যায়ভাবে জুলাই হত্যাযজ্ঞে জড়িত ছিল তাদেরকেও দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে৷ যারা ২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে তারা বিপ্লবী সেনা, অভ্যুত্থানের নায়ক৷ তাদের গ্রেফতার করার পূর্বে সারজিস, হাসনাত, নাহিদ, আসিফসহ বাকিদেরও গ্রেফতার করতে হবে৷ আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তাদেরকে কোনো প্রকার হয়রানি করা যাবে না ৷ অন্য অপরাধ থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
এখনো বিভিন্ন থানায় কিছু পুলিশ সদস্যের টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে৷ মিথ্যা মামলায় চাপ প্রয়োগের কথা শোনা যাচ্ছে। এতো রক্তপাত আর জীবনের বিনিময়ের পরও যেসব কালপ্রিটরা এখনো ঘুস খায় তারা শহীদের রক্তকে কলঙ্কিত করছে৷ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
পুলিশের ওপর দেশের জনগণ আস্থা রাখতে চায়। তবে সেই আস্থা নিজেদের কাজের মাধ্যমে পুলিশকেই ফিরিয়ে আনতে হবে। বিগত বছরগুলোতে পেশাদারিত্ব ভুলে গিয়ে অনেক পুলিশ সদস্যের দলের হয়ে তোষামদকারী হিসেবে কাজ করার পরিণতি কী হতে পারে কিংবা ‘বাংলাদেশ পুলিশ’ নামক প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদাবোধ কোথায় নিয়ে গিয়েছে সেটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। আশা করি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে ভবিষ্যতে পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের পরিচয় দেবে এবং প্রত্যাশিত গৌরব ফিরিয়ে আনবে।’
ইকবাল হোসেন মজনু/এফএ/এএসএম