পর্যটকে মুখর কক্সবাজার সৈকত
টানা চারদিনের ছুটিতে পুরোনো রূপে ফিরেছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত দুইমাস ঘরবন্দি থাকা লোকজন বেড়াতে বেরিয়েছেন। দুর্গা পূজার ছুটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় সবার লক্ষ্য এখন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। এ কারণে দুর্গাপূজার বন্ধের সঙ্গে সাপ্তাহিক এবং নির্বাহী আদেশের ছুটি মিলিয়ে বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) থেকে চারদিনের ছুটিকে কাজে লাগাচ্ছেন ভ্রমণপ্রেমীরা।
পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, শরতের মেঘ-রোদ্দুর খেলা সৈকতকে আরো মায়াবী করে তুলে। এ দৃশ্য উপভোগে প্রতিবছর এ সময়ে কক্সবাজারে পর্যটকের ভিড় বাড়ে। কিন্তু যখন-তখন চাইলেও চাকরিজীবীরা বেড়াতে বেরুতে পারেন না। কিন্তু এবার দুর্গাপূজা ও অন্য ছুটি মিলিয়ে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত পর্যটক সমাগম সমান্তরাল থাকতে পারে কক্সবাজারে। ইতোমধ্যে ১০-১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ৯০-৯৮ শতাংশ হোটেল রুম বুকিং হয়েছে। আর ১৪-১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৮০-৮৫ শতাংশ রুম আগাম বুকড। তবে পর্যটক টানতে প্রায় প্রতিটি হোটেল ৪০-৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিয়েছেন রুম ভাড়ায়।
তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস লিমিটেডের বিপণন বিভাগের কক্সবাজার অফিস প্রধান ইমতিয়াজ নূর সুমেল বলেন, টানা ছুটিতে ৯৫ শতাংশ আগাম বুকিং পেয়েছি। এরপর ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত বুকিং রয়েছে ৮০-৮৫ শতাংশ। পর্যটন সরব করতে ৪০-৪৫ শতাংশ এবং ক্ষেত্র বিশেষে ৫০ শতাংশ ছাড়ও দিয়েছি। ভোজনে ভিন্ন স্বাদ দিতে তিনদিনের জন্য যাত্রা করা ইলিশ উৎসব ভোজন রসিকদের জন্য ২০ অক্টোবর পর্যন্ত করা হয়েছে। যে কেউ চাইলে স্বল্পমূল্যে ৮ ক্যাটাগরির ইলিশ রান্নার স্বাদ নিতে পারেন।
কক্সবাজারে থাকা পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউসে দৈনিক প্রায় সোয়া লাখ পর্যটকের রাত যাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। তারকা হোটেলগুলো ইতোমধ্যে ৯০ শতাংশ বুকিং হয়েছে। গেস্ট হাউসগুলোও কমবেশি বুকিং হয়েছে বলে জেনেছি। তিন পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায়, দুর্গাপূজার ছুটি দিয়ে কক্সবাজারে এবারের পর্যটন মৌসুমটা চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
হোটেল সি-নাইট গেস্ট হাউজের ব্যবস্থাপক শফিক ফরাজী বলেন, টানা বন্ধে অতীতেও প্রায় প্রতিটি আবাসিক প্রতিষ্ঠান কমবেশি পর্যটক পেত। বৃহস্পতিবার হতে চারদিনের ছুটিতেও তেমনটি হচ্ছে। টানা ছুটি কাজে লাগানোর কারণে, দুর্গাপূজার ছুটিতে পর্যটকের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে কক্সবাজারে।
কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, পর্যটকদের সেবা দিতে দরিয়া নগরের আবাসিক প্রতিষ্ঠান সাজিয়ে পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। সরকারি ছুটির পরও শনিবার পর্যন্ত ভ্রমণ পিয়াসীরা কক্সবাজার অবস্থান করবেন বলে আশা করছি। এ কয়েকদিনে লাখো পর্যটক কক্সবাজারে অবস্থানে কয়েকশ কোটি টাকা বাণিজ্য হতে পারে।
তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু বলেন, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের। নিয়মিত ব্যবসা না থাকলে ঋণের ওপর প্রতিষ্ঠান চালানো হাতি পোষার মতো। ২০১২ সাল থেকে কোনো না কোনো কারণে ভর মৌসুমেও পর্যটকশূন্য সময় কাটাতে হচ্ছে। তবে ভ্রমণপিয়াসীদের সেবা দিতে আমরা সবসময় প্রস্তুত থাকি।
হোটেল দি কক্স টু-ডের সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক আবু তালেব শাহ বলেন, অনেকদিন পর পর্যটকের সাড়া পেয়ে আনন্দ লাগছে। অতিথিদের পরিচ্ছন্ন আবহ দিতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন সবাই।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি হতে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা এমএ সবুর বলেন, দীর্ঘদিন পর বাড়ির সবাইকে নিয়ে সৈকত তীরে এসেছি। চারপাশের পরিবেশ দেখে হতাশই হতে হয়েছে। সৈকতের বেলাভূমিতে আগের সৌন্দর্য্য নেই। চারপাশে যেন অযত্ন-অবহেলা। চাইলে, পুরো পর্যটন এলাকা দৃষ্টিনন্দন করা যেত।
হোয়াইট অর্কিড হোটেলের জিএম রিয়াদ ইফতেখার বলেন, কক্সবাজার দিয়ে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায়, সেভাবে পর্যটনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন নেই। এরপরও দীর্ঘ সৈকত, হিমছড়ি, দরিয়ানগর, ইনানি, মহেশখালী, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কসহ জেলায় কিছু পর্যটন স্পট থাকায় লোকজন আসেন। ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য আরও সুযোগ তৈরি করা দরকার।
ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের তত্ত্বাবধায়ক (ইনচার্জ) মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, গত অর্থবছরে পার্কটি আধুনিকায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট হামলায় অবকাঠামো ও নানা সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প ভাঙনের কবলে পড়েছে। এরপরও অতীত অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে পর্যটক বরণে প্রস্তুত সাফারি পার্ক। টানা বন্ধে এখানে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সমাগম ঘটে লক্ষণীয়। দর্শনার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী বলেন, অনেকদিন পর উল্লেখ করার মতো পর্যটক বেড়াতে আসবে-সেটাই কাম্য। গড়ে ৫০-৮০ হাজার পর্যটক সপ্তাহখানেক সময় কক্সবাজার অবস্থান করলে পর্যটন অনুষঙ্গ সব সেক্টর মিলে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪২০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাণিজ্য হতে পারে।
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি মাহফুজুল ইসলাম বলেন, পর্যটক আগমন বাড়বে- সেটা মাথায় রেখে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ও অপরাধ দমনে কয়েকটি ভাগে সাজানো হয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশকে। টেকনাফ ও ইনানিসহ সব পর্যটন স্পটে ট্যুরিস্ট পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। সৈকতে পোশাকধারী পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে থাকবে টহল ও সাদা পোশাকের পুলিশ।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, সৈকতের প্রবেশপথে তল্লাশি চৌকি স্থাপন, পোশাকধারীর পাশাপাশি সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, ভ্রমণপিপাসুদের বিচরণ নির্বিঘ্ন ও হয়রানি এড়াতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের একাধিক টিম মাঠে রয়েছে। সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের প্রসারই আমাদের মূল লক্ষ্য।
সায়ীদ আলমগীর/আরএইচ/জেআইএম