বিচারককে প্রভাবিতের চেষ্টা
নওগাঁয় এজলাসে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের হট্টগোল
নওগাঁয় আদালতের এজলাসে হট্টগোল করে বিচারকের আদেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের বিরুদ্ধে। এজলাস কক্ষে হট্টগোলের দুটি ভিডিও হাতে এসেছে এই প্রতিবেদকের। যা দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের পরিচয়।
ভিডিওতে হট্টগোলের সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নওগাঁর সাবেক সভাপতি জাকারিয়া হোসেনসহ বেশ কয়েকজন বিএনপিপন্থি আইনজীবীকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।
আদালত সূত্র বলছে, গত সোমবার (০৭ অক্টোবর) দুপুরে সদর আমলী আদালতে জেলা বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের মামলায় (জিআর ৩৬০/২৪) এজাহারভুক্ত আসামি শিক্ষক ফজলুল হক আত্মসমর্পণ করেন। এ সময় আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন চান তিনি। স্বপক্ষে বিদ্যালয়ের প্রত্যয়নপত্র দাখিল করেন। এজাহারে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই বলে উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী।
ওই মুহূর্তে এজলাসে উপস্থিত বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ওই শিক্ষককে কারাগারে পাঠাতে চিল্লাচিল্লি শুরু করেন। তবে তারা বাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন না। অর্থাৎ বাদীর পক্ষে আইনজীবী হিসেবে তাদের ওকালতনামা ছিল না।
এরইমধ্যে আসামির বিরুদ্ধে এজাহারে কোনো ধরনের অভিযোগ না থাকলেও তার জামিন নামঞ্জুরের জন্য উচ্চস্বরে বিচারকের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। পরে আদালত তার অবস্থানে থেকে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল পর্যন্ত আসামির জামিন মঞ্জুর করেন।
এই আদেশ দেওয়ার পর এজলাস ত্যাগ করেন আইনজীবীরা। কিন্তু ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই এজলাসে আবারো প্রবেশ করেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নওগাঁর বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সরওয়ার জাহানসহ অন্যান্যরা। ওই মুহূর্তে তারা বিচারককে উদ্দেশ্য করে নানা ধরনের কথা বলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ওই মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন আল আশিক ইমরান হিল্লোল। এই বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে চান না বলে জানান তিনি।
এদিকে কোর্টের কর্মচারীরা ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিলেও নাম প্রকাশ করতে চাননি।
ওই আদালতে উপস্থিত থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আদালতে হট্টগোল করার বিষয় শতভাগ ঠিক। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরাই এটা করেছে।
ওই দিনই বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-২ এর বিচারকের আদালতেও একই ধরনের হট্টগোল করেন বলে জানায় আদালত সূত্র। মহাদেবপুর আমলী আদালতের একটি মামলায় (জিআর ৩১৪/২৪) ৮২ জন আসামি আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। কোর্টে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি জানান, এ সময় জামিনে বাধা দেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। এজলাসে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের কোনো ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগও দেওয়া হয়নি।
পরে আদালতে হট্টগোল লাগিয়ে আসামিদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠাতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা এজলাসের টেবিলে আঘাত করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। সেখানে ১০ জনের বেশি বিএনপিপন্থি আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। পরে এজলাসে এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করা আসামিদের দরখাস্ত ফেরত দেন বিচারক। অর্থাৎ আসামিদের জামিন হয়নি। কারাগারেও নেওয়া হয়নি। তারা ফিরে গেছেন।
এই ঘটনার ভিডিও জাগো নিউজের কাছে রয়েছে। তবে এজলাসের মধ্যে হট্টগোলের কথা স্বীকার করলেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে ওই কোর্টের কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নওগাঁ জেলা ও দায়রা জজ আদালত সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর (৫ আগস্টের) বিভিন্ন সময়ে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-১, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-৪ ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৫ এর বিচারকদের চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের পক্ষে আদেশ নেওয়ার চেষ্টা করেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নওগাঁর সাবেক সভাপতি জাকারিয়া হোসেন দাবি করেন, এজলাসে রাজনৈতিক মামলা শুনানির সময় একাধিক আইনজীবী থাকলে পরিবেশ আলাদা হয়ে যায়। তখন একসঙ্গে অনেকে কথা বলা শুরু করেন। তবে সেখানে প্রভাব বিস্তার করার কোনো ঘটনা ঘটেনি।
তিনি আরও দাবি করেন, শুনানির সময় আমরা কোর্টকে বলেছি গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত এসব আইনের মামলা যেভাবে চলেছে এখনো সেভাবে চলা উচিত। মামলাগুলো জেলা জজের আদালতে দিতে বলেছি। আমরা এসব মামলায় হাইকোর্ট পর্যন্ত গিয়েছি। আদালতে আমরা বলেছি এটা স্পেশাল আইনের মামলা। বিচারকের সামনে জোরে কথা বলার সুযোগ নেই। এজলাসের বাইরে রাজনৈতিক বক্তব্য ভিন্ন।
এজলাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করলে এই দলের ওপর মানুষের আস্থা হারাবে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক নওগাঁ জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুর রহমান রেজভী।
তিনি বলেন, আইনের প্রতি আমাদের সকলের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। কারোর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সেটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন আইনজীবীরা। বিচারিক কার্যক্রমে অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে সাধারণ মানুষের চরম ভোগান্তি হয়।
এফএ/জিকেএস